শ্রীরামকৃষ্ণ-পুঁথি সম্বন্ধে আচার্য শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দের অভিমত
শাঁকচুন্নীর১ বই এইমাত্র পড়লাম। তাকে আমার লক্ষ-লক্ষাধিক প্রেমালিঙ্গন দিবে। তার কণ্ঠে তিনি আবির্ভাব হচ্ছেন। ধন্য শাঁকচুন্নী। শাঁকচুন্নী ঐ পুঁথি সকলকে শোনাক। মহোৎসবে শাঁকচুন্নীর পুঁথি সকলের সামনে যেন পড়ে। পুঁথি অতি বড় যদি হয় তো চুম্বক চুম্বক করে যেন পড়ে। শাঁকচুন্নী একটাও আবোল-তাবোল তো লিখে নাই। আমি তার পুঁথি পড়ে যে কি আনন্দ পেয়েছি, তা আর কি বলব! শাঁকচুন্নীর পুঁথি যাতে খুব বিক্রি হয়, সকলে পড়ে (মিলে) চেষ্টা করবে। তারপর শাঁকচুন্নীকে গাঁয়ে গাঁয়ে প্রচার করতে যেতে বলো। বাহবা, সাবাস, শাঁকচুন্নী। সে তাঁর কাজ করছে। গাঁয়ে গাঁয়ে যাক, লোককে তাঁর কথা শোনাক — এর চেয়ে তার আর কি ভাগ্য হবে?... শশী, শাঁকচুন্নীর পুঁথি and শাঁকচুন্নী himself (নিজে) must electrify the masses (জনসাধারণে শক্তিসঞ্চার করবে)। আরে মোর শাঁকচুন্নী, তোকে প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করছি ভাই! প্রভু তোর কণ্ঠে বসুন, দ্বারে দ্বারে তাঁর নাম শুনাও। সন্ন্যাসী হবার আবশ্যক কিছুই নাই। শশী, mass (জনসাধারণ)-এর মধ্যে সন্ন্যাসী হওয়া উচিত নয়। শাঁকচুন্নী is the future apostle for the masses of Bengal (বাঙলার জনসাধারণের নিকট ভাবী বার্তাবহ)। শাঁকচুন্নীকে খুব যত্ন করবে। তার বিশ্বাস-ভক্তির ফল ফলেছে। শাঁকচুন্নীকে এই ক-টা কথা লিখতে বলো — তার তৃতীয় খণ্ডে, প্রচার খণ্ডে:
'বেদবেদান্ত, আর আর সব অবতার যা কিছু করে গেছেন, তিনি একলা নিজের জীবনে তা করে দেখিয়ে গেছেন। তাঁর জীবন না বুঝলে বেদবেদান্ত অবতার প্রভৃতি বোঝা যায় না-কেন না, He was the explanation (তিনি ব্যাখ্যাস্বরূপ ছিলেন)। তিনি যেদিন থেকে জন্মেছেন, সেদিন থেকে সত্যযুগ এসেছে। এখন সব ভেদাভেদ উঠে গেল, আচণ্ডাল প্রেম পাবে। মেয়ে-পুরুষ-ভেদ, ধনী-নির্ধনের ভেদ, পণ্ডিত-বিদ্বান-ভেদ, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল-ভেদ সব তিনি দূর করে দিয়ে গেলেন। আর তিনি বিবাদভঞ্জন-হিন্দু-মুসলমান-ভেদ, ক্রিশ্চান-হিন্দু ইত্যাদি সব চলে গেল। ঐ যে ভেদাভেদে লড়াই ছিল, তা অন্য যুগের; এ সত্যযুগে তাঁর প্রেমের বন্যায় সব একাকার।'
এই ভাবগুলো তার ভাষায় বিস্তার করে লিখতে বলবে। যে তাঁর পূজা করবে, সে অতি নীচ হলেও মুহূর্তমধ্যে অতি মহান্ হবে — মেয়ে বা পুরুষ। আর এবারে মাতৃভাব-তিনি মেয়ে সেজে থাকতেন, তিনি যেন আমাদের মা-তেমনি সকল মেয়েকে মার ছায়া বলে দেখতে হবে। ভারতে দুই মহাপাপ-মেয়েদের পায়ে দলানো, আর 'জাতি জাতি' করে গরীবগুলোকে পিষে ফেলা। He was the Saviour of women, Saviour of the Masses, Saviour of all high and low.২ আর শাঁকচুন্নী ঘরে ঘরে তাঁর পূজা করাক। ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, মেয়ে বা পুরুষ — তাঁর পুজোয় সকলের অধিকার। যে ঘটস্থাপনা বা প্রতিমা করে তাঁর পূজা করবে — মন্ত্র হোক বা না হোক — যেমন করে যে-ভাষায় যার হাত দিয়ে হোক-খালি ভক্তি করে যে পূজা করবে, সেই ধন্য হয়ে যাবে। এই ডৌলে লিখতে বলো। কুছ পরোয়া নাই; প্রভু তার সহায় হবেন। কিমধিকমিতি
নরেন্দ্র
১ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-পুঁথি প্রণেতা অক্ষয়কুমার সেন মহাশয়কে স্বামীজী আদর করিয়া 'শাঁকচুন্নী' নামে ডাকিতেন। স্বামী বিবেকানন্দ শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার সেনকে শ্যামপুকুরে 'শাঁকচুন্নী মাস্টার' আখ্যা দেন —
"জনে জনে আখ্যা দিলা নরেন্দ্র এখানে।
সৌভাগ্যবিদিত হৈনু শাঁকচুন্নী নামে ॥"
তাঁহার বর্ণ ছিল ঘনকৃষ্ণ এবং শরীর রুগ্ন ও মধ্যমাকৃতি-সমস্ত মিলিয়া প্রায় কদাকার বলিলেই হয়। স্বামীজী সম্ভবত এই জন্যই রহস্যপূর্বক তাঁহাকে এই নাম দিয়াছিলেন। কলকাতায় ঠাকুরদের বাড়িতে বালকদিগকে পড়াইতেন বলিয়া তাঁহার অপর নাম ছিল 'অক্ষয় মাস্টার'। 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপুঁথি' রচনা করিয়া ইনি অক্ষয়কীর্তি লাভ করিয়াছেন।
এই 'পুঁথি'র প্রশংসায়
স্বামীজী শতমুখ
ছিলেন —"তাঁর কণ্ঠে তিনি আবির্ভাব হচ্ছেন। ধন্য শাঁকচুন্নী! ... আমি তাঁর
পুঁথি পড়ে যে কি আনন্দ পেয়েছি তা আর কি বলব! ... আরে মোর শাঁকচুন্নী, তোরে
প্রাণখুলে আশীর্বাদ করছি, ভাই! ... শাঁকচুন্নী বাঙলার জনসাধারণের ভাবী
বার্তাবহ।”
২
তিনি স্ত্রীজাতির উদ্ধারকর্তা,
ইতরসাধারণের উদ্ধারকর্তা, উচ্চ-নীচ সকলের উদ্ধারকর্তা।