তৃতীয় খণ্ড

প্রভুদর্শনে দক্ষিণেশ্বরে কেশবের আগমন


জয় জয় রামকৃষ্ণ অখিলের স্বামী ।
জয় জয় গুরুমাতা জগৎ-জননী ॥
জয় জয় দোঁহাকার যত ভক্তগণ ।
সবার চরণরেণু মাগে এ অধম ॥


সুধার সাগর সম রামকৃষ্ণকথা ।
মিঠায় কি পরিমাণে নাহয় ইয়ত্তা ॥ ১ ॥

যেন কথা-আন্দোলনে থাক সদা মন ।
স্মরি গুরু প্রভুদেব তমোবিমোচন ॥ ২ ॥

কেশব সেনের সঙ্গে লীলা যে প্রকার ।
গাইলে শুনিলে ভক্তি-চৈতন্য-সঞ্চার ॥ ৩ ॥

ব্রাহ্ম ব্রহ্মশক্তি সমতুল্য হয় জ্ঞান ।
সাকার সে নিরাকার এক ভগবান ॥ ৪ ॥

ব্রাহ্ম শ্রীকেশব সেন সর্বজনে জানা ।
অতিমান্য অগ্রগণ্য ধন্য এক জনা ॥ ৫ ॥

কবিরাজ বৈদ্যবংশে তাঁহার উদ্ভব ।
পিতা পিতামহগণ কৃষ্ণভক্ত সব ॥ ৬ ॥

বংশগত ধর্মে নাহি তাঁর রতিমতি ।
বাল্যাবধি কেশবের স্বতন্ত্র প্রকৃতি ॥ ৭ ॥

দেশেতে ইংরেজী বিদ্যা চলন এখন ।
উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজভাষা-অধ্যয়ন ॥ ৮ ॥

নিতি নিতি অধ্যয়নে বিদ্যা বেড়ে যায় ।
বিশেষ ব্যুৎপন্ন হৈল ইংরেজী ভাষায় ॥ ৯ ॥

ভাষার ধরন যেন তেন তাঁয় গড়ে ।
বাইবেল গ্রন্থ-পাঠে অনুরাগ পড়ে ॥ ১০ ॥

ছেড়ে গেল বিদ্যারাগ ধর্মপথে টান ।
সরল হৃদয়ে করে তাঁহার সন্ধান ॥ ১১ ॥

গ্রন্থের মধ্যেতে তত্ত্ব হয় অন্বেষণ ।
সেই হেতু দিবারাতি চলে অধ্যয়ন ॥ ১২ ॥

তার সঙ্গে কার্যগত হইল আচার ।
অসাত্ত্বিক খাদ্য যত যত্নে পরিহার ॥ ১৩ ॥

প্রার্থনা প্রাণের বস্তু বিভুর উদ্দেশে ।
সৎপথ সৎদৃষ্টি মিলে তাঁর কিসে ॥ ১৪ ॥

মঙ্গল-আলর ভক্তপ্রিয় ভগবান ।
অলক্ষ্যে লাগাম ধরি কেশবে চালান ॥ ১৫ ॥

বাহ্য-অন্তে সরলতা সেই সে কারণে ।
নবীনে কেশবচন্দ্র সুপ্রবীণ জ্ঞানে ॥ ১৬ ॥

গম্ভীরতা স্থির বৃদ্ধি অকপট মতি ।
বক্রভাবাপন্নহীন সহজ প্রকৃতি ॥ ১৭ ॥

অল্পভাষী মিষ্টভাষ নির্জনপ্রিয়তা ।
অনুরাগে করে চর্চা ঈশ্বরের কথা ॥ ১৮ ॥

তেজপূর্ণ সূক্ষ্ম দৃষ্টি আপনা শাসনে ।
বিবেক-বৈরাগ্য বৃদ্ধি-চেষ্টা দিনে দিনে ॥ ১৯ ॥

ভাবী ফলশালী বৃক্ষ চারায় যেমন ।
লহ লহ কচি পাতা সবুজ বরন ॥ ২০ ॥

নূতন নূতন ফেলে প্রত্যেক সকালে ।
তেমতি কেশবচন্দ্র উঠে কুতুহলে ॥ ২১ ॥

সমাধ্যায়ী আয়বন্ধু সকলের পাশ ।
মনোগত ধর্মভাব করেন প্রকাশ ॥ ২২ ॥

প্রায় যায় উপহাসে কি করিয়া বুঝে ।
না হইলে কেশবের সমকক্ষ তেজে ॥ ২৩ ॥

নিহিত অন্তরে ঐশী শক্তির আবেশ ।
না হইলে জীবে কিসে করিবে প্রবেশ ॥ ২৪ ॥

ঘোর বৈরাগ্যের কথা বিবেককাহিনী ।
বিপরীত বুঝে যত জগতের প্রাণী ॥ ২৫ ॥

ঘুমন্ত কেশব নয় উন্মীলিত আঁখি ।
কতক্ষণ আগুন বসনে থাকে ঢাকি ॥ ২৬ ॥

বাহিরিল নিজ তেজে গতি কেবা রোধে ।
প্রচারিতে নিজ মত কর্তব্যানুরোধে ॥ ২৭ ॥

বলিতে বলিতে হেখা সেথা বার বার ।
বলিবার শক্তি ঘটে ফুটিল অপার ॥ ২৮ ॥

বক্তা নামে হৈল খ্যাত বীর বলবান ।
যে মাখা উন্নত তারে সহজে নুয়ান ॥ ২৯ ॥

ইংরাজীতে কেশবের বক্তৃতার চোটে ।
শ্বেতকায় মিশনারি চমকিয়া উঠে ॥ ৩০ ॥

হেন সুকৌশল তর্কে বাঁধা কথা তাঁর ।
প্রতিবাদে সম্মুখীন সাধ্য নহে কার ॥ ৩১ ॥

কর্কশস্বভাৰ কথা নহে কোন কালে ।
যদিও আগুন ছুটে যে সময় বলে ॥ ৩২ ॥

মূর্তিতে মিঠানি যেন তেমন কথায় ।
মনে হয় শুনি শুনি যেন না ফুরায় ॥ ৩৩ ॥

উচ্চভাবযুক্ত এত সরলে বাহির ।
মনে হয় বরপুত্র বাগ্‌বাদিনীর ॥ ৩৪ ॥

ভাবেতে যদিও কথা বাঁকা স্থানে স্থানে ।
ধরিতে নারিত কেহ বিদ্যাবল গুণে ॥ ৩৫ ॥

সরলতা-বল আর বিদ্যা-বল দুয়ে ।
কেশবে গৌরবী কৈল কেশব করিয়ে ॥ ৩৬ ॥

সত্ত্বগুণে সরলতা-লতা সুকোমল ।
ভক্তপ্রিয় ঈশ্বরের আদরের স্থল ॥ ৩৭ ॥

সতত বেষ্টিত লতা থাকে ভগবানে ।
প্রসবে মধুর ফল কুসুম উদ্যমে ॥ ৩৮ ॥

ক্রমশঃ কেশব এত সদ্‌গুণে ভূষিত ।
দেখিলেই সবে বুঝে ঈশ্বর-জানিত ॥ ৩৯ ॥

বিলাতে ইংলণ্ডদেশে যাত্রা একবার ।
গুণী মানী তথাকার হাজার হাজার ॥ ৪০ ॥

স্বভাবসুলভ নম্র বিনীতাচরণে ।
বিদ্যাবল-পরিচয় বক্তৃতা-শ্রবণে ॥ ৪১ ॥

আসিত আশ্রমে কত দেখিতে তাঁহায় ।
কেশবের এখন এতেক শক্তি গায় ॥ ৪২ ॥

ইংলণ্ডের রানী যিনি ভারত-ঈশ্বরী ।
সমান আসন যেন সমাদর করি ॥ ৪৩ ॥

প্রাসাদে আপন ঘরে ল'য়ে গিয়ে তাঁরে ।
বুঝ মন কত শক্তি শ্রীকেশব ধরে ॥ ৪৪ ॥

দেশে কি বিদেশে তুল্য সমাদর তাঁর ।
ক্রমশঃ ক্রমশঃ পরে পাবে সমাচার ॥ ৪৫ ॥



ধর্মভাব কেশবের শুনহ এখন ।
মহেশ গণেশ বিভু নিত্য নিরঞ্জন ॥ ৪৬ ॥

গুণময় সগুণ যে ব্রহ্ম নিরাকার ।
সৃজন পালন লয় শক্তির আধার ॥ ৪৭ ॥

পিতা পাতা সবাকার পুরুষপ্রধান ।
পূর্ণব্রহ্ম নিত্যানন্দ ব্যাপ্ত সর্বস্থান ॥ ৪৮ ॥

ইন্দ্রিয়বিহীন আছে ইন্দ্রিয়াদি স্থির ।
বিশাল সৃষ্টির মধ্যে বিক্রম জাহির ॥ ৪৯ ॥

অখণ্ড অনাদি ঈশ সর্বশক্তিমান ।
অক্ষয় অমর অন্তহীন গুণধাম ॥ ৫০ ॥

ন্যায়পরায়ণব্রত মঙ্গল-আচার ।
হেন নিরাকার ব্রহ্ম উপাস্য তাঁহার ॥ ৫১ ॥

সাকারে স্বীকার নহে খণ্ড বোধ হয় ।
প্রতিমা-পুতুল-পূজা পূজাযোগ্য নয় ॥ ৫২ ॥

আচারী বৈষ্ণব খ্যাত বৈদ্যকুলোদ্ভব ।
যেখানে পুত্রের নাম থুইল কেশব ॥ ৫৩ ॥

সে বৎশেতে নিরাকারবাদী জন্মে ছেলে ।
হাসিবে বৈষ্ণবকুল এ কথা শুনিলে ॥ ৫৪ ॥

হাসির তো নয় কথা লীলার খবর ।
বাহ্যে দেখিবার নয় দ্রষ্টব্য ভিতর ॥ ৫৫ ॥

শক্তিধর শ্রীকেশব ঈশ্বরের জানা ।
জীব নহে কর্মচারী ভাবে তাঁরে আনা ॥ ৫৬ ॥

কিবা কর্ম করাইলা ধর্মের কারণ ।
এই লীলামঞ্চ ধরা যাহার সৃজন ॥ ৫৭ ॥

সুন্দর কখন শুন লীলাদৃষ্টি হবে ।
বৈষ্ণবের চূড়ামণি কেশবে দেখিবে ॥ ৫৮ ॥

কোনরূপে কিবা পথে কোথা কার গতি ।
কোথার বিশ্রামশয্যা আনন্দ-সংহতি ॥ ৫৯ ॥

আনন্দে আনন্দময় পরিণাম ফল ।
একা ভাগবতীলীলা দেখিবার স্থল ॥ ৬০ ॥

সাকার শ্রীকেশবের শেষ পরিণাম ।
পরম আনন্দময় বিশ্রামের স্থান ॥ ৬১ ॥

নিরাকার পথে হবে কার্যহেতু গতি ।
শুনহ মধুর রামকৃষ্ণলীলা-গীতি ॥ ৬২ ॥



নানা জাতি ধর্ম এবে ভারতে প্রচার ।
বিধিংসম্প্রদায়ভুক্ত বিবিধ আচার ॥ ৬৩ ॥

সর্বশ্রেষ্ঠ তাঁর ধর্ম গায় জনে জনে ।
বহু হিন্দুবংশ মজায়েছে খ্রীষ্টিয়ানে ॥ ৬৪ ॥

ধর্মভাবে আত্মভাব মিলায়ে এখন ।
ব্রাহ্মধর্মে শ্রীকেশব হইল মিলন ॥ ৬৫ ॥

বহুভাষাশাস্ত্রদর্শী ব্রাহ্মণসন্তান ।
খ্যাত্যাপন্ন শ্রীরামমোহন রায় নাম ॥ ৬৬ ॥

ব্রাহ্মধর্ম-রীতি-নীতি-গঠন তাঁহার ।
বিদ্যা-বুদ্ধি-শক্তিবলে করিল প্রচার ॥ ৬৭ ॥

ধর্ম-অঙ্গে বেদান্তের অতি অল্প ছায়া ।
বাকি বাদ নিজে গ'ড়ে পুরাইল কায়া ॥ ৬৮ ॥

খ্রীষ্টিয়ান সম ধারা আচারেতে মিলে ।
হিন্দুধর্ম-অঙ্গ ইহা কেহ কেহ বলে ॥ ৬৯ ॥

কি ধর্ম কিসের ধর্ম ভিতরে কি তার ।
এ বিচারে কিছু মম নাহি অধিকার ॥ ৭০ ॥

রায়ের গঠিত ধর্মে উন্নতি প্রচুর ।
বর্তমান নেতা যার দেবেন্দ্র ঠাকুর ॥ ৭১ ॥

ভ্রষ্টাচার হেতু এঁরা পিরালী ব্রাহ্মণ ।
শহরেতে গুণে মানে খ্যাতি বিলক্ষণ ॥ ৭২ ॥

সমর্থন ব্রাহ্মধর্ম হয় বিধিমতে ।
এমন সময় দিলে শ্রীকেশব পথে ॥ ৭৩ ॥

উত্তরের রথে যেন সারথি অর্জুন ।
তার তিল অণুরুণা কিছু নহে ঊন ॥ ৭৪ ॥

ব্রাহ্মধর্মে সেইমত হইল কেশব ।
দিন দিন জয়বৃদ্ধি ভূরি ভূরি রব ॥ ৭৫ ॥

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা উচ্চ আখ্যাধারী ।
সৎকুলসমুত্তর গুণ মান ভারি ॥ ৭৬ ॥

ধনে জমিদার, কার উচ্চ পথে স্থান ।
ইংরেজরাজের ঘরে অতুল সম্মান ॥ ৭৭ ॥

নতশিরে হেন কত শত অগণন ।
কেশবের ধর্মব্যাখ্যা করিয়া শ্রবণ ॥ ৭৮ ॥

দলভুক্ত হয় তাঁর ল'য়ে পদধূলি ।
বংশগত জাতি গর্বে দিয়া জলাঞ্জলি ॥ ৭৯ ॥

কেশবের বলে ব্রাহ্মধর্ম সমুজ্জ্বল ।
দিন দিন বাড়ে কায়া যত বাড়ে দল ॥ ৮০ ॥

স্থানে স্থানে প্রচারক করেন প্রেরণ ।
হাটে বাটে উচ্চরবে পর্য-সংকীর্তন ॥ ৮১ ॥

দলগত ভক্ত যাঁরা তাঁদের আবাসে ।
মাঝে মাঝে মহোৎসব দিবসবিশেষে ॥ ৮২ ॥

ভজনার জন্য আদিসমাজ প্রধান ।
এখানে মঞ্জুর সহ প্রভু ভগবান ॥ ৮৩ ॥

আসিয়াছিলেন আগে বলিয়াছি সব ।
যে দিন প্রভুর চক্ষে পড়িল কেশব ॥ ৮৪ ॥

মহা অনুরাগে ভরা দেখি ভক্তজনা ।
বলিয়াছিলেন প্রভু নড়িছে ফাতনা ॥ ৮৫ ॥

এইবারে খাবে বড় মাছ টোপে তার ।
অপর যতেক দেখ আসক্তি আচার ॥ ৮৬ ॥

পরে পরস্পর দেখা বেলঘরিয়ায় ।
বলিলেন কেশবে বেঙাচি তুলনায় ॥ ৮৭ ॥

এখন সৌভাগ্য সূর্য উদয় তাঁহার ।
কেশবচরণে করি কোটি নমস্কার ॥ ৮৮ ॥



বিশ্বগুরু ঠাকুর আমার গুরুবেশে ।
যাচিয়া আপুনি গেলা কেশবের পাশে ॥ ৮৯ ॥

জল দিতে ভক্তমনে তৃষার আঙুর ।
শুন রামকৃষ্ণকথা শ্রুতিসুমধুর ॥ ৯০ ॥

সরল অন্তরে চিন্তা যে করে হরির ।
শ্রীপ্রভু তাঁহার দড় শতত অস্থির ॥ ৯১ ॥

জাতিধর্মকর্মভেদ বিচারবিহীনে ।
সহস্র দৃষ্টান্ত পাবে লীলা-অন্বেষণে ॥ ৯২ ॥

প্রভুসনে সম্মিলনে ব্রাহ্মভক্তগণ ।
নূতন আনন্দ কি যে কৈল আস্বাদন ॥ ৯৩ ॥

তাঁদের কাগজে আছে লিপিবদ্ধ করা ।
যতদূর সাধ্যমত দিনের চেহারা ॥ ৯৪ ॥

বিশেষতঃ কেশবের আনন্দ প্রচুর ।
যাঁহার উপরে লক্ষ্য বিশেষ প্রভুর ॥ ৯৫ ॥

সর্বোপরি শ্রীকেশবে বেঙাচি তুলনা ।
সে শ্রীবাক্য হৃদে তাঁর জাগে ষোল আনা ॥ ৯৬ ॥

কি দেখিল কি পাইল প্রভুর বচনে ।
ভকত ব্যতীত তত্ত্ব কেহ নাহি জানে ॥ ৯৭ ॥

শ্রীমুখনির্গত বাক্য সুমিষ্ট কোমল ।
তবু ব্রহ্মবাণ জিনে এত ধরে বল ॥ ৯৮ ॥

বাণে যেন বাজে প্রাণে প্রাণ করে ক্ষয় ।
শ্রীপ্রভুর বাক্যবাণ সে ভাবের নয় ॥ ৯৯ ॥

রণক্ষেত্রে বীর যেন অন্ধকার-বাণে ।
টঙ্কারিয়া ধনুর্বাণ বিপক্ষেরে হানে ॥ ১০০ ॥

বাণধর্মবলে দশ দিক অন্ধকার ।
আঁখি সত্ত্বে শত্রু ধরে অন্ধের আকার ॥ ১০১ ॥

শ্রেষ্ঠতর হয় যদি প্রতিদ্বন্দী জন ।
সূর্যবাণে অন্ধকার করে নিবারণ ॥ ১০২ ॥

সেইমত কলিকালে রাজ্য অবিদ্যার ।
জুড়িয়া অজ্ঞানবাণ ধনুকে তাহার ॥ ১০৩ ॥

রাখিয়াছে জীবগণে নিজ অধিকারে ।
হৃদয় তিমিরখনি ভীষণ আঁধারে ॥ ১০৪ ॥

ভাগ্যবলে প্রভুদেব সুপ্রসন্ন যায় ।
অহেতুক রূপা-সিন্ধু দ্রবিয়া দয়ায় ॥ ১০৫ ॥

ছাড়েন বাক্যের বাণ সন্ধানিয়া স্থান ।
অমনি চৈতন্য তথা, পলায় অজ্ঞান ॥ ১০৬ ॥



কেশবের হৃদে বাক্যবাণ শ্রীপ্রভুর ।
অজ্ঞান-তিমির যাহা ছিল কৈল দূর ॥ ১০৭ ॥

চৈতন্য-অরুণ সমুদিত হৃদিমাঝে ।
মূর্তিমান হ'য়ে বাক্য নাচে মহাতেজে ॥ ১০৮ ॥

থেকে থেকে শ্রীকেশব উঠেন চমকি ।
ভাবে সাধুবাক্যে কিবা অপরূপ দেখি ॥ ১০৯ ॥

বিচারিয়া মনে মনে যুক্তি কৈল সার ।
দেখিতে হইবে কিবা ভিতরে ব্যাপার ॥ ১১০ ॥

অদ্ভুত বাক্য দেখি অদ্ভূত সাধু ।
না জানি আর কি ক্ষত আছে তাঁর মধু ॥ ১১১ ॥

সেই হেতু উপযুক্ত শিষ্য কয় জনে ।
পাঠান জানিতে তত্ত্ব শ্রীপ্রভুর স্থানে ॥ ১১২ ॥

শিষ্যকয় দিনত্রয় দক্ষিণশহরে ।
বুঝিতে প্রভুর তত্ত্ব পাছু পাছু ফিরে ॥ ১১৩ ॥

অনন্ত ভাবের ভাবী শ্রীপ্রভু আপনি ।
কি বুঝিবে তাঁরে নরে অতিক্ষুদ্র প্রাণী ॥ ১১৪ ॥

কি সাধ্য নরের শিরে কতটুকু বল ।
অণুকণা তত্ত্বে যাঁর মহেশ পাগল ॥ ১১৫ ॥

অহর্নিশ চতুর্মুখ চারি মুখে গায় ।
তথাপি তিলেক তত্ত্ব খুঁজিয়া না পায় ॥ ১১৬ ॥

জপিয়া হাজার মুখে না পেরে তল্লাস ।
মহানাগ দুঃখে করে ক্ষিতিতলে বাস ॥ ১১৭ ॥

লজ্জায় মাটিতে ঢাকি অনন্তবয়ান ।
থেকে থেকে মাঝে মাঝে হয় কম্পমান ॥ ১১৮ ॥

বিফলপ্রয়াস দেব-ঋষি-মুনিগণ ।
আজন্ম আচরি মহা কঠোর সাধন ॥ ১১৯ ॥

হেন তত্ত্বাতীত যেথা ব্রহ্মা শিব হারে ।
সামান্য মানুষ দেখে কি বুঝিতে পারে ॥ ১২০ ॥

তদুপরি নাহি তাহে সাকারে বিশ্বাস ।
সেখানে প্রভুরে বুঝা মাত্র উপহাস ॥ ১২১ ॥

অপার খেলার খেলী শ্রীপ্রভু আপুনি ।
অব্যক্ত অচিন্তনীয় অখিলের স্বামী ॥ ১২২ ॥

তায় চোদ্দপোয়া মাপ নরদেহ ধরা ।
দীনহীন নিরক্ষর গুপ্ত সাজ পরা ॥ ১২৩ ॥

ধরাধামে সাধ্য কার ধরে প্রভুদেবে ।
যে যায় বুঝিতে যায় মহাসন্দে ডুবে ॥ ১২৪ ॥

ভগবানে জীবে ঠিক বিপরীত কথা ।
জীবে বুঝে বিপরীত হরির বারতা ॥ ১২৫ ॥

সে হেতু পাগল জ্ঞান জীবগণে করে ।
হেরিয়া হরির ভাব নরের আধারে ॥ ১২৬ ॥

প্রভুর দ্বিবিধ ভাব প্রতি ক্ষণে ক্ষণে ।
ভাবভেদে নানা কথা ফুটে শ্রীবদনে ॥ ১২৭ ॥

কভু গান হর হর শিব শিব নাম ।
কভু জয় রঘুপতি সীতাপতি রাম ॥ ১২৮ ॥

কভু রাধাকৃষ্ণ ব'লে আনন্দে বিহ্বল ।
কভু মত্ত হরিনামে চক্ষে ঝরে জল ॥ ১২৯ ॥

কখন উন্মত্তপ্রায় কালী কালী বলি ।
কখন মহিমাস্তব কভু কত গালি ॥ ১৩০ ॥

কভু ব্যাকুলিত চিতে শিশুর মতন ।
কোথা মা কোথা যা বলি কতই রোদন ॥ ১৩১ ॥

কখন গোউর বলি করতালি দিয়া ।
ভুঞ্জেন অপূর্বানন্দ নাচিয়া নাচিয়া ॥ ১৩২ ॥

মহান সমাধি কভু দেহভাব নাই ।
দেহ ছেড়ে যেন কোথা গেছেন গোসাঁই ॥ ১৩৩ ॥

কভু কালীকৃষ্ণে দুয়ে মিশাইয়া গান ।
প্রেমভক্তিভাবে ভরা শুনে ফুলে প্রাণ ॥ ১৩৪ ॥

কখন কাপড় পরা অঙ্গ-আচ্ছাদন ।
অল্পবয়ঃ শিশুসম উলঙ্গ কখন ॥ ১৩৫ ॥

কোমল শয্যায় কভু খাটের উপরি ।
কভু ধুলারাশি গায় ভূমে গড়াগড়ি ॥ ১৩৬ ॥



ভাগ্যবান কেশবের শিষ্য তিন জন ।
প্রভুর বিবিধ ভাব করি ঘরশন ॥ ১৩৭ ॥

পরস্পর বিচারিয়া করিলেন সার ।
প্রভু এক সাধু ভক্ত আশ্চর্য প্রকার ॥ ১৩৮ ॥

আশ্চর্য প্রকার কেন ঠিক নাই ভাবে ।
এহেন অবস্থা মাত্র শুরুর অভাবে ॥ ১৩৯ ॥

শুনে আসে হাসি তাই প্রভুদেবে কয় ।
শিষ্য-উপদেষ্টা কেশবের শিষ্যত্রয় ॥ ১৪০ ॥

আপনার দেখি সাধুভক্তের আচার ।
ভাল হবে উপদেশ করিলে স্বীকার ॥ ১৪১ ॥

আচার্য শ্রীকেশবের লউন শরণ ।
নিশ্চয় চতুরবর্গ ফল উপার্জন ॥ ১৪২ ॥

অজ্ঞানের গুনি কণা গুণের সাগর ।
নীচে লেখা গীত গেয়ে দিলেন উত্তর ॥ ১৪৩ ॥

আমার কি ফলের অভাব,
তোরা এলি একি ফল নিয়ে ।
পেয়েছি যে ফল জনম সফল,
রামকল্পতরু হৃদয়ে রোপিয়ে ।
শ্রীরাম-করাতর-বৃক্ষমূলে রই,
যে ফল বাঞ্ছা করি সে ফল প্রাপ্ত হই,
শুন ফলের কথা কই, ও ফল গ্রাহক নই,
যাব তোদের প্রতিফল যে দিয়ে ॥


গানে কিবা বুঝিলেন ব্রাহ্ম তিন জন ।
পালটি কেশবাচার্যে কহে বিবরণ ॥ ১৪৪ ॥

কেশব চৈতন্যবান চৈতন্যের তেজে ।
গুপ্তসার মধ্যে কিবা বার্তা পেয়ে বুঝে ॥ ১৪৫ ॥

ব্যাকুল পরান হৈল দরশন তরে ।
শিষ্যসহ আগমন দক্ষিণশহরে ॥ ১৪৬ ॥

অতি পুলকিত চিত দেখি প্রভুদেবে ।
প্রভুও তেমতি খুশী পাইয়া কেশবে ॥ ১৪৭ ॥



নিরাকার সাকার ব্যতীত যাহা আর ।
সকলেতে প্রভু নিজে সর্বমুলাধার ॥ ১৪৮ ॥

সাকারের মধ্যে যত ভিন্ন ভিন্ন রূপ ।
সকলেই শ্রীপ্রভুর নিজের স্বরূপ ॥ ১৪৯ ॥

অকূল অপার যেন অসীম সাগরে ।
নানান দেশের নদী তাহে এসে পড়ে ॥ ১৫০ ॥

যেবা কেহ যেই রূপ যেই নাম ল'য়ে ।
ভজে পুজে সর্বেশ্বরে সরল হৃদয়ে ॥ ১৫১ ॥

সকল আসিয়া পড়ে শ্রীপ্রভুর ঠাঁই ।
বিশ্বাধার বিশ্বশুরু জগৎগোসাঁই ॥ ১৫২ ॥

সর্বশক্তিমান প্রভু সকলের মূলে ।
যে চায় আশ্রয় পায় শ্রীচরণতলে ॥ ১৫৩ ॥

প্রভুর নিকটে নাই কোনই বিচার ।
হিন্দু কি মুসলমান সব একাকার ॥ ১৫৪ ॥

যেমন মহান বৃক্ষ বনমধ্যগত ।
অগণ্য প্রশাখা শাখা চৌদিকে ব্যাপৃত ॥ ১৫৫ ॥

ফলফুলপত্রে পরিপূর্ণ শোভমান ।
যেই পাখী এসে বসে সেই পায় স্থান ॥ ১৫৬ ॥

তেমতি আশ্রয়দাতা শ্রীপ্রভু আপনি ।
প্রসারিত কল্পতরু-চরণ দুখানি ॥ ১৫৭ ॥

যে কোন মানুষ আসে প্রভু-সন্নিধানে ।
সে কেমন কিবা ভাব কি হেতু সেখানে ॥ ১৫৮ ॥

কেমনে গঠন হবে কিবা প্রয়োজন ।
সব তত্ত্ব দেখা মাত্র হয় নিরূপণ ॥ ১৫৯ ॥

দয়াগার অহেতুক রূপাসিন্ধু প্রভু ।
এত রূপা কোন যুগে নাহি শুনি কভু ॥ ১৬০ ॥

ভজন পূজন কিছু নহে দরকার ।
করিলে প্রভুরে একমাত্র নমস্কার ॥ ১৬১ ॥

কি মিলে অমূল্য নিধি না যায় বর্ণন ।
জোরে যার ছিঁড়ে যায় ভবের বন্ধন ॥ ১৬২ ॥

চরণে শরণ ল'য়ে চরণে যে পড়ে ।
গড়ন না গড়ি প্রভু নাহি দেন ছেড়ে ॥ ১৬৩ ॥

বিশ্বকারিগর প্রভু কি গড়েন হাতে ।
তুচ্ছ আমি পরিচয় না পারিমু দিতে ॥ ১৬৪ ॥

কি গড়িলা প্রভুদেব কেশবে লইয়া ।
স্মরি গুরু দেখ মন নয়ন মুদিয়া ॥ ১৬৫ ॥



কেশবে কহিলা প্রভু দেখামাত্র তাঁরে ।
প্রফুল্ল মুখরবিন্দে হাসি নাহি ধরে ॥ ১৬৬ ॥

খুশী আজ শ্যামা বড় তোমার উপর ।
যাও গিয়ে শ্রীমন্দিরে মারে কর গড় ॥ ১৬৭ ॥

যখন যে ভাগ্যবান প্রভু দেখিবারে ।
আসিতেন ভক্তিসহ দক্ষিণশহরে ॥ ১৬৮ ॥

প্রায় অধিকাংশে বলিতেন ভগবান ।
শ্রীমন্দিরে কর অগ্রে মায়েরে প্রণাম ॥ ১৬৯ ॥

সেই আজ্ঞা শ্রীকেশবে মঙ্গললক্ষণ ।
ভক্তিভরে বন্দিবারে মায়ের চরণ ॥ ১৭০ ॥

শুনিয়া কেশব কন অতি ধীরে ধীরে ।
মন-প্রাণ সমর্পণ করেছি পিতারে ॥ ১৭১ ॥

ভাব বুঝি প্রভুদেব করিলা উত্তর ।
কহ কার খেয়ে মাই পুষ্ট কলেবর ॥ ১৭২ ॥

যদি মাতৃ-পয়োধরে হেন কান্তি কায় ।
বল তবে কেন নাহি মানিবে শ্যামায় ॥ ১৭৩ ॥

মা ধরিয়া বাপে চিনে জগজনে জানা ।
বুদ্ধিমান তুমি তবু কি হেতু বুঝ না ॥ ১৭৪ ॥

কেশব প্রভুরে পুনঃ কহে ভক্তিভরে ।
কেবা মাতা আপনার মা বলেন কারে ॥ ১৭৫ ॥

কিরূপ আকার তাঁর কিরূপ গঠন ।
বলুন বিশেষ করি কিছু বিবরণ ॥ ১৭৬ ॥

পাত্র বুঝি শ্রীকেশবে প্রভুর উত্তর ।
বিলাতে গিয়াছ তুমি দেখেছ সাগর ॥ ১৭৭ ॥

অনন্ত আকাশ যদি দেখেছ নয়নে ।
তবে মোর মা কেমন জিজ্ঞাসিছ কেনে ॥ ১৭৮ ॥

ব্রহ্মাণ্ড-উদরা মাতা জগৎজননী ।
ব্রহ্মময়ী শক্তি সিদ্ধিশান্তিস্বরূপিণী ॥ ১৭৯ ॥

নির্গুণ নিষ্ক্রিয় ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়ের পার ।
বিকারবিহীন যেন তেন নিরাকার ॥ ১৮০ ॥

তাঁহার উদ্ভব-শক্তি শক্তি প্রাণরূপ ।
শক্তিই আপনি সেই ব্রহ্মের স্বরূপ ॥ ১৮১ ॥

ব্রহ্ম যিনি ঠিক তিনি স্থিরসিন্ধু প্রায় ।
তরঙ্গস্বরূপ শক্তি খেলিছে তাঁহায় ॥ ১৮২ ॥

শক্তিতে জগৎ-সৃষ্টি শক্তি সর্ববল ।
শক্তিই কেবল মাত্র স্থিতির সম্বল ॥ ১৮৩ ॥

শক্তি আছে তাই আছি শক্তিই ধারণা ।
সেই শক্তিবলে করি সাধন-ভজনা ॥ ১৮৪ ॥

যে শক্তিতে লীলাকার্য তাঁরে শক্তি গাই ।
শক্তিহীনে সৃষ্টিশূন্য ব্রহ্ম নাই পাই ॥ ১৮৫ ॥

শক্তিই কেবল বল ব্রহ্মদরশনে ।
প্রতিবিম্বে বস্তুজ্ঞান যেমন দর্পণে ॥ ১৮৬ ॥

দর্পণস্বরূপা শক্তি সহায় না হ'লে ।
ব্রহ্মতত্ত্ব ব্রহ্মজ্ঞান কখন না মিলে ॥ ১৮৭ ॥

বিরাট মুরতিখানি চৌদ্দপোয়া নয় ।
সীমাবদ্ধ করা বুদ্ধি ভ্রান্তির আলয় ॥ ১৮৮ ॥

পুনঃ প্রশ্ন করিলেন কেশব সজ্জন ।
বিশাল বিরাট মূর্তি অনন্ত রকম ॥ ১৮৯ ॥

অতি ক্ষুদ্র নরশির তায় নাহি ধরে ।
তাঁরে কেন আনা হয় প্রতিমা-আকারে ॥ ১৯০ ॥

শুনি কথা কেশবের প্রভুর উত্তর ।
ধরা হ'তে বড়গুণে বড় দিবাকর ॥ ১৯১ ॥

কিন্তু মানুষের চক্ষে হয় দরশন ।
ঠিক যেন একখানি থালার মতন ॥ ১৯২ ॥

তেমতি বিরাট মূর্তি প্রতিমা-ভিতরে ।
সীমাবদ্ধ বোধ হয় দূরত্বানুসারে ॥ ১৯৩ ॥

আকারের হেতু ক্ষুদ্র কখনই নয় ।
বহু দূরস্থিত তাই ক্ষুদ্র বোধ হয় ॥ ১৯৪ ॥

বৃহতী যেমন তিনি তেমতি করুণা ।
ব্রহ্মময়ী মা বলিয়া তাঁহারে ডাক'না ॥ ১৯৫ ॥

এত কাল পিতা বলি কি কাজ করিলে ।
এই বার ডাক তুমি ব্রহ্মময়ী ব'লে ॥ ১৯৬ ॥

বারে বারে বন্দি শ্রীকেশবচন্দ্র সেনে ।
পিরীতি করিলা যায় শ্রীপ্রভু আপনে ॥ ১৯৭ ॥

মহামন্ত্র মা'র নাম দিলা কর্ণমূলে ।
ধন্য ধন্য ভাগ্যধর জনম ভূতলে ॥ ১৯৮ ॥

সিদ্ধবাক্য হৃদিমধ্যে পড়িল যেমন ।
তখনি অঙ্কুর তায় উঠে সুশোভন ॥ ১৯৯ ॥

সাধন-ভজন-চাষ নহে দরকার ।
প্রভুর শ্রীবাক্যে এত শকতি অপার ॥ ২০০ ॥

আনন্দের তোড় এত কেশবের ঘটে ।
মনে নাই কিসে গেল দীর্ঘদিন কেটে ॥ ২০১ ॥

দিন যায় প্রায় শিষ্যগণ কহে তাঁরে ।
হইল আগত কাল ফিরিবারে ঘরে ॥ ২০২ ॥

শ্রীকেশব দীনদুঃখী বিনীতের প্রায় ।
করজোড়ে প্রভুদেবে মাগিল বিদায় ॥ ২০৩ ॥

মিষ্টিমুখ করাইয়া সহ শিষ্যগণে ।
কেশবে বিদায় প্রভু দিলেন সে দিনে ॥ ২০৪ ॥



দেহ ল'য়ে গৃহে গেল কেশব এখন ।
কিন্তু শ্রীপ্রভুর কাছে পাছু আছে মন ॥ ২০৫ ॥

প্রভুর বচন প্রেম-ভক্তিরসে ভরা ।
সপর্যায় সর্বদাই হয় তোলাপাড়া ॥ ২০৬ ॥

বিশেষতঃ শক্তির সম্বন্ধে কথা যত ।
নৃত্য করে হৃদে তাঁর শক্তিসমবেত ॥ ২০৭ ॥

শক্তিসহ বিনির্গত প্রভুর বচন ।
প্রবেশিয়া অন্তে করে আকার ধারণ ॥ ২০৮ ॥

ক্রমে পরে হেন কান্তি ভাতি উঠে তার ।
জীবেরে সামান্ত কথা শিবেরে নাচায় ২০৯ ॥

মুর্তিমতী শক্তি দেখি আনন্দের ভরে ।
আনন্দময়ীরে ডাকে সমাজ-মন্দিরে ॥ ২১০ ॥

মিষ্টি পেয়ে মা'র নামে প্রাণ খুলে গায় ।
যত ডাকে তত মিঠা তাহাতে বেরায় ॥ ২১১ ॥

মিষ্টির আকর প্রভু পাইয়া সন্ধান ।
দক্ষিণশহরে লোভে পুনশ্চ পয়ান ॥ ২১২ ॥

কারিগর প্রভুর মতন কেবা আছে ।
পিটিয়া গড়ন নয় গড়া তাঁর ছাঁচে ॥ ২১৩ ॥

সাধন-ভজন নাই কথায় কথায় ।
উচ্চতত্ত্ব মায়ামত্ত্ব জীবে বুঝা যায় ॥ ২১৪ ॥

যোজন যোজনান্তরে মেঘ শূন্যে বুলে ।
যে কল-কৌশলে তারে পাড়ে ভূমিতলে ॥ ২১৫ ॥

সেইরূপ শ্রীপ্রভুর কৌশলের ধারা ।
বুঝিতে জীবের বুদ্ধি হয় বুদ্ধিহারা ॥ ২১৬ ॥

কোথায় কেশব ছিল কোথা যায় চ'লে ।
স্মরিয়া শ্রীগুরু দেখ আড়ালে আড়ালে ॥ ২১৭ ॥

মহাবক্তা কেশবের বাক্য গেছে ছুটে ।
নিরক্ষর দীনবেশ প্রভুর নিকটে ॥ ২১৮ ॥

প্রভুবাক্যে কত দর বুঝিয়া আপনে ।
প্রতি বর্ণ প্রত্যক্ষর মন দিয়া শুনে ॥ ২১৯ ॥

ডুবাইয়া গোটা মন বাক্যে মাতোয়ারা ।
নব প্রস্ফুটিত ফুলে যেমন ভ্রমরা ॥ ২২০ ॥

হৃদয় বুঝিয়া তাঁর প্রভুদেব কন ।
সদ্য ভক্তিপ্রদায়িনী ভক্তিবিবরণ ॥ ২২১ ॥

জ্ঞান-ভক্তি এক যদি তবু দু'প্রকার ।
জ্ঞানমার্গ শুষ্কতর পুরুষ আকার ॥ ২২২ ॥

প্রখর তপন তাপ আগুনের মত ।
তীব্রতেজী প্রলয়াগ্নি দেখে হয় ভীত ॥ ২২৩ ॥

হাতে খাঁড়া জ্ঞানমার্গী তার মধ্যে ধায় ।
মহাবীর পরানের পানে না তাকায় ॥ ২২৪ ॥

সদর অন্দর আছে ঈশ্বরের ঘরে ।
জ্ঞানমার্গী সদর পর্যন্ত যেতে পারে ॥ ২২৫ ॥

ভকতি কোমলপ্রাণা স্ত্রীলোকের জাতি ।
সুশীতল ছায়াতলে মৃদু-মন্দ গতি ॥ ২২৬ ॥

অন্তঃপুরে যেতে পারে মানা নাহি তার ।
যথায় কমলাসহ হরির বিহার ॥ ২২৭ ॥

ভক্তিপথ আশ্রয় করিয়া তুমি থাক ।
পরানন্দময়ী ব্রহ্মময়ী মাকে ডাক ॥ ২২৮ ॥



ষট্‌চক্রভেদকথা শুনিয়াছ মন ।
গুরু বিনা বিশ্বে নাহি বুঝে কোন জন ॥ ২২৯ ॥

চক্রমধ্যে প্রবেশিতে শক্তি নাহি কার ।
শক্তি যাঁর তিনি ভবসিন্ধুকর্ণধার ॥ ২৩০ ॥

অকূলেতে ভ্রাম্যমাণ জীবরূপ তরী ।
উদ্ধারে নিরাশ যদি না মিলে কাণ্ডারী ॥ ২৩১ ॥

কাণ্ডারী জুটিলে হ'লে প্রতিকূল বাত ।
পলে লক্ষ নিদারুণ তরঙ্গ-আঘাত ॥ ২৩২ ॥

তথাপি উড়ায়ে পাল হেনভাবে চলে ।
ও পলে অকূলে যেবা এ পলে সে কূলে ॥ ২৩৩ ॥

যাহার যেমন ভাব তাই রক্ষা করি ।
শ্রীপ্রভু কেমন হন কাহার কাণ্ডারী ॥ ২৩৪ ॥

দেখিবারে সাধ যদি হয় তোর মন ।
মন দিয়া লীলা-গীতি করহ শ্রবণ ॥ ২৩৫ ॥



কেশবে বলেন শুন ভক্তির বারতা ।
যে পায় ভকতি বল তার সম কোথা ॥ ২৩৬ ॥

ভক্তি বড় বাসে শ্যামা বশ ভক্তিবলে ।
ভক্তি দিয়া পূজ তাঁর চরণকমলে ॥ ২৩৭ ॥

মহামন্ত্ররূপী তাঁর শ্রীমূখের বাণী ।
বাক্যরূপে দিলা শক্তি ভক্তি-প্রসবিনী ॥ ২৩৮ ॥

ভক্তির স্বরূপ কিবা বর্ণনে না ফুটে ।
ইন্দ্রত্ব ব্রহ্মত্ব তুচ্ছ যাহার নিকটে ॥ ২৩৯ ॥

হেন ভক্তি প্রভুবাক্যে পায় অনায়াসে ।
কামিনী-কাঞ্চনাসক্ত কলির মানুষে ॥ ২৪০ ॥

মহাশক্তি প্রভুবাক্যে মিশান থাকিত ।
পাষাণে পড়িলে তাহে ভকতি ফুটিত ॥ ২৪১ ॥

অতি গুহ্যতম তত্ত্ব প্রভুবাক্য তেজে ।
কৃপাপাত্র তিলমাত্র আভাসেতে বুঝে ॥ ২৪২ ॥

ঈশ্বরাবতার বিনা এ শক্তি কোথায় ।
প্রত্যক্ষ দূরের কথা শুনা নাহি যায় ॥ ২৪৩ ॥

এ শক্তির নামান্তর কৃপা বলি যারে ।
গাইতে মানস কিন্তু বাক্যে নাহি সরে ॥ ২৪৪ ॥

বোবার স্বপন যেন না হয় প্রকাশ ।
কৃপাতত্ত্ব ব্যক্তচেষ্টা মাত্র উপহাস ॥ ২৪৫ ॥

বিখ্যাত কেশব এত বিদ্যাবল ধরে ।
নূতন তর্কের সৃষ্টি মুহূর্তেকে করে ॥ ২৪৬ ॥

যথার্থ সিদ্ধান্ত যত কাটে তর্ক করি ।
বদ্ধবাক্ শুনে বড় বড় মিশনারি ॥ ২৪৭ ॥

মহান্ত বিশেষ লোক প্রশান্ত সুধীর ।
সরল আধার ক্ষেত্র সৎ-গুণাদির ॥ ২৪৮ ॥

অন্তর যেমন বাহ্যে কান্তিমাখা তাঁর ।
ভারতে চৌদিকে চেলা হাজার হাজার ॥ ২৪৯ ॥

সমাজমন্দির কত বসে স্থানে স্থানে ।
সে কেবল একমাত্র কেশবের গুণে ॥ ২৫০ ॥

এমন কেশব যাঁর শক্তি এত ঘটে ।
প্রভুর নিকটে কেন বাক্য নাহি ফুটে ॥ ২৫১ ॥

শ্রীচরণতলে লুটে মুখে নাই সাড়া ।
লালায়িত দরশনে দীনহীন পারা ॥ ২৫২ ॥

কিবা বস্তু প্রভুদেব বলিতে না পারে ।
আপনে দেখিয়া শুদ্ধ শ্রীশ্রীপদে পড়ে ॥ ২৫৩ ॥

আভাসেতে শুন ভক্তি কৃপার লক্ষণ ।
বক্তা বোবা বন্ধ হয় যাবৎ বচন ॥ ২৫৪ ॥

কভু মত্ততর হ'য়ে বলিবারে যায় ।
কি বলি কি বলি করে না আসে ভাষায় ॥ ২৫৫ ॥

হাসে কাঁদে করে নৃত্য আপনার ভাবে ।
পিতা মাতা নেতা ত্রাতা দেখে প্রভুদেবে ॥ ২৫৬ ॥

শ্রীচৈতন্যদাতা প্রভু পতিতপাবন ।
নয়নাবরণ-মায়া-তমোবিমোচন ॥ ২৫৭ ॥

মর্ত্যে বাস মধুলুব্ধ মধুপ যেমন ।
বুলিতে বুলিতে যদি মিলে অন্বেষণ ॥ ২৫৮ ॥

পারিজাতকুসুম-কানন দৈব-বলে ।
নিতি নিতি তথা নাহি বসে অন্ত ফুলে ॥ ২৫৯ ॥

সেইমত শ্রীকেশব প্রভুর নিকটে ।
মত্তপ্রায় এখন তখন আসে ছুটে ॥ ২৬০ ॥



একদিন প্রভুদেব শ্রীকেশবে কন ।
দেখ না কেশব তুমি বক্তা একজন ॥ ২৬১ ॥

কতই না জান ভাল ধর্মের কাহিনী ।
ইচ্ছা আজ তোমার নিকটে কিছু শুনি ॥ ২৬২ ॥

বক্তাবর ভক্তবর জ্ঞানিজনগণ্য ।
ধীমান সদ্‌গুণবান কপটতাশূন্য ॥ ২৬৩ ॥

শিক্ষিত বিনয়যুক্ত সত্যতত্ত্বান্বেষী ।
স্বভাবসুলভধারা সুধাধারাভাষী ॥ ২৬৪ ॥

বিবেক-বৈরাগ্যমাখা শুদ্ধতর মতি ।
শ্রীকেশব ব্রাহ্মধর্ম-রথের সারথি ॥ ২৬৫ ॥

পদতলে সমাসীন কন ধীরে ধীরে ।
ছুঁচ বিক্রি কিবা কথা কামারের ঘরে ॥ ২৬৬ ॥

আরে মন যদি বুদ্ধি থাকে এক ফোঁটা ।
বুঝ কিবা কেশবের উত্তরের ঘটা ॥ ২৬৭ ॥

কি ছটা মিশান তাঁর ভিতরে ভিতরে ।
যে প্রভু জগৎমুগ্ধ তাঁরে মুগ্ধ করে ॥ ২৬৮ ॥

ভক্তিপ্রীতিভরা শুনি কেশবের বাণী ।
মহাসমাধিগত হইলা তখনি ॥ ২৬৯ ॥

ভাবভঙ্গে কেশবের হৃদি বুঝি কন ।
সদ্যভক্তিপ্রদায়িনী ভক্তি-বিবরণ ॥ ২৭০ ॥

দেখ ভাগবত ভক্ত আর ভগবান ।
তর তম নাহি তিনে বুঝিবে সমান ॥ ২৭১ ॥

কেশব চমকে শুনি শ্রীপ্রভুর কথা ।
মনে ভাবে এ কেমন নূতন বারতা ॥ ২৭২ ॥

প্রভুবাক্যে অবিশ্বাস সাহস না হয় ।
কিন্তু মনে সন্দেহের তরঙ্গ-উদয় ॥ ২৭৩ ॥

সর্বজ্ঞ শ্রীপ্রভুদেব বুঝি নিজ মনে ।
কেশবে কহেন কিছু শক্তি-সঞ্চালনে ॥ ২৭৪ ॥

শুন শুন শ্রীকেশব ভাগবত পুঁথি ।
তাহাতে বর্ণিত মাত্র লীলার ভারতী ॥ ২৭৫ ॥

অক্ষরে লিখিত মাত্র কাগজ-উপরে ।
শুনে বর্ণে বর্ণে হরি উদ্দীপনা করে ॥ ২৭৬ ॥

শুধু উদ্দীপনা নয় ঈশ্বরীয় ভাব ।
গাইলে শুনিলে হয় হৃদে আবির্ভাব ॥ ২৭৭ ॥

ভাবরূপে হন হরি হৃদয়ে উদয় ।
ভাব-আনুকূল্যে পরে দরশন হয় ॥ ২৭৮ ॥

কানেতে শুনিয়া কথা চক্ষে দেখে হরি ।
সেই হেতু ভাগবতে হরি-জ্ঞান করি ॥ ২৭৯ ॥

পুনশ্চ দেখহ ভক্ত-হৃদয় মাঝারে ।
ভক্তপ্রিয় ভগবান সর্বদা বিহরে ॥ ২৮০ ॥

পুণ্য-দরশন ভক্ত করি দরশন ।
তখনি অমনি করে গুরু-উদ্দীপন ॥ ২৮১ ॥

ভক্ত-দরশন আর ভক্ত-সঙ্গ-বলে ।
ভবের কাণ্ডারী হরি অসাধনে মিলে ॥ ২৮২ ॥

প্রত্যক্ষ এ সব বাক্য না বুঝিবে আন ।
যারে ধরি মিলে হরি সে তাঁর সমান ॥ ২৮৩ ॥

অবাকে নীরব হেথা কেশব বসিয়া ।
কি কর দেখেন কিবা কলমে আঁকিয়া ॥ ২৮৪ ॥

কর্ণমূলে প্রভুবাক্য বাক্যরূপে পশে ।
অপূর্ব আকার ধরে অন্তরে প্রবেশে ॥ ২৮৫ ॥

কেশবের ভাগ্যসীমা নাহি যার বলা ।
শ্রীপ্রভু যেমন গুরু তাঁর মত চেলা ॥ ২৮৬ ॥

প্রভুদেবে গুরুরূপে পায় যেই জনা ।
মহাভাগ্যবান নাই সৌভাগ্যের সীমা ॥ ২৮৭ ॥

গুরুভাব পিতৃভাব কর্তাভাব আর ।
প্রভুর মনেতে নহে কখন সঞ্চার ॥ ২৮৮ ॥

অহংভাবহীন তিনি দ্বীনের মুরতি ।
কর্ণমুলে মন্ত্রদান কভু নহে রীতি ॥ ২৮৯ ॥

আপনারে গুরুজ্ঞানে অন্তে উপদেশ ।
নাহি ছিল এ ভাবের গন্ধমাত্র লেশ ॥ ২৯০ ॥

তথাপিহ সিদ্ধমন্ত্র ঝুড়ি ঝুড়ি পায় ।
যে আসে প্রভুর পাশে তাহার আশায় ॥ ২৯১ ॥

ভব-রোগ-বৈদ্য প্রভু পূর্ণ নাড়ী-জ্ঞান ।
রোগ অনুসারে হয় ঔষধ-বিধান ॥ ২৯২ ॥

মৃত্যুঞ্জয় শাস্তিরস পোষ্টাই কারণ ।
যখন তখন যারে তারে বিতরণ ॥ ২৯৩ ॥

কেশব যেমন বড় বড় বাই তাঁর ।
প্রাণান্তে সাকার কথা না করে স্বীকার ॥ ২৯৪ ॥

কেমনে সারিল বাই কৃপা-বড়ি জোরে ।
সুন্দর আখ্যান মন কব পরে পরে ॥ ২৯৫ ॥

রামকৃষ্ণলীলা-গীতি মহৌষধি প্রায় ।
গাইলে শুনিলে নাহি বাই থাকে গায় ॥ ২৯৬ ॥