চতুর্থ খণ্ড
নরেন্দ্রের মিলন
জয়
প্রভু
রামকৃষ্ণ অখিলের স্বামী ।
জয় জয় শ্যামাসুতা জগৎ-জননী ॥
জয় জয় দোঁহাকার যত ভক্তগণ ।
সবার চরণরেণু মাগে এ অধম ॥
এবে বড় মত্ততর ভক্তবর রাম ।
বিশ্বগুরু শ্রীপ্রভুর পাইয়া সন্ধান ॥ ১ ॥
নানা স্থানে করিছেন মহিমা প্রচার ।
ভবনে বসান আছে ভক্তের বাজার ॥ ২ ॥
মুক্তহস্তে ব্যয় ভক্তসেবার কারণ ।
আপনি যেমতি তাঁর গৃহিণী তেমন ॥ ৩ ॥
আত্মীয় কুটুম্ব বন্ধু যে রহে যেখানে ।
সকলে লইয়া যান প্রভু-দরশনে ॥ ৪ ॥
এ সময়ে নিকট আত্মীয় একজন ।
বয়স বিংশতি বর্ষ কিংবা কিছু কম ॥ ৫ ॥
সুন্দর বালক যেন সুন্দর আকৃতি ।
বিশাল নয়নদ্বয় রাজর্ষি-মূরতি ॥ ৬ ॥
নয়ন-পিরীতি অতি অতি বুদ্ধিমান ।
রতি-মতি ভগবানে ধর্মপথে টান ॥ ৭ ॥
নরেন্দ্র তাঁহার নাম নরেন্দ্র-বিশেষ ।
আধারে অনেক গুণ গুণে নহে শেষ ॥ ৮ ॥
উজ্জ্বল জাতির কুল তাঁহার জনমে ।
কোর্টের উকিল পিতা বিশ্বেশ্বর নামে ॥ ৯ ॥
শহরেতে শিমলায় করেন বসতি ।
সমাজে লোকের মাঝে দোষে গুণে খ্যাতি ॥ ১০ ॥
জুটিলেন এইবার প্রভুর সদনে ।
শুনিয়া মোহন নাম রামের বদনে ॥ ১১ ॥
ভাবী মহাতরুবর ফল-ফুলে ভরা ।
সুশীতল ছায়াশালী বিস্তৃত চেহারা ॥ ১২ ॥
কত পত্র-শাখা-প্রশাখাদি অগণন ।
গোড়ায় চারায় ভাসে লক্ষণ যেমন ॥ ১৩ ॥
সেইমত নরবর নরেন্দ্রের গায় ।
বাল্যাবধি লক্ষণাদি স্পষ্ট দেখা যায় ॥ ১৪ ॥
মন দিয়া গুন কই তাঁহার ভারতী ।
জন্মাবধি দেখি তাঁর স্বতন্ত্র প্রকৃতি ॥ ১৫ ॥
অতিথি সন্ন্যাসী ত্যাগী আসিলে দুয়ারে ।
গোপনে দিতেন তিনি যা পেতেন ঘরে ॥ ১৬ ॥
নয়নে কখন ভাল না লাগে কামিনী ।
ঘৃণা তায় যেন কালকূটভরা ফণী ॥ ১৭ ॥
কামিনী যে ভালবাসে সেও ভাল নয় ।
স্বভাব-সুলভ ধর্ম শুন পরিচয় ॥ ১৮ ॥
পুতুল লইয়া খেলা শৈশবে যখন ।
রাম ও সীতার মূর্তি সুন্দর গড়ন ॥ ১৯ ॥
ছিল তাঁর খেলিবার যুগল-মুরতি ।
রচিয়া খেলার ঘর খেলা নিতি নিতি ॥ ২০ ॥
একদিন জিজ্ঞাসা করিলা কোন জনে ।
রামের সম্পর্ক কিবা জানকীর সনে ॥ ২১ ॥
রামের ঘরণী সীতা গুনিয়া উত্তরে ।
অমনি মুরতি দুটি ফেলিলেন ছুঁড়ে ॥ ২২ ॥
বিবাহে বিরূপ বড় ঘৃণা গুরুতর ।
তিয়াগী বিরাগী যথা তথায় আদর ॥ ২৩ ॥
যোগ তপাচার শিব-জটাভার শিরে ।
পিরীতি পড়িল পরে তাঁহার উপরে ॥ ২৪ ॥
ফুল দিয়া দিন দিন ভক্তিসহ পূজা ।
পাতা দিয়া কলিকায় টানা হয় গাঁজা ॥ ২৫ ॥
যাঁহার যেমন ভাব তাঁরে তেন গড়ে ।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই ধাত বাড়ে ॥ ২৬ ॥
নিত্যসিদ্ধ নিত্যমুক্ত প্রভু ভক্ত যাঁরা ।
সত্য বটে তাঁহাদের নরের চেহারা ॥ ২৭ ॥
স্বভাব-প্রকৃতি কিন্তু পূরা স্বতন্তর ।
জাগা জৈবভাবশূন্য প্রশান্ত অন্তর ॥ ২৮ ॥
বিবেক বিরাগ জ্ঞান ভক্তি প্রেম গায় ।
বুঝিতে জীবের বুদ্ধি ঘোল খেয়ে যায় ॥ ২৯ ॥
সাধারণ নিয়মের বহির্ভূত তাঁরা ।
প্রভুর বচনে লাউ কুমড়ার পারা ॥ ৩০ ॥
আগে গাছে ধরে ফল তার পরে ফুল ।
জগতে কাহার সঙ্গে নহে সমতুল ॥ ৩১ ॥
ভক্তের ভিতরে খেলে বিভূতি প্রভুর ।
শুন ভক্তসংজোটন কাণ্ড সুমধুর ॥ ৩২ ॥
নিত্য-সিন্ধ-মুক্ত প্রভুভক্ত যতজন ।
সর্বোপরি নরেন্দ্রের সর্বোচ্চ আসন ॥ ৩৩ ॥
গৃহীর কি আছে কথা আসক্তিতে জারা ।
বলিলেই চোরে চোর আধখানি মরা ॥ ৩৪ ॥
সময়েতে কব কথা সময়ের মত ।
নরেন্দ্র শৈশব, নহে দশম অতীত ॥ ৩৫ ॥
মুদিলে নয়নদ্বয় নিদ্রার সময় ।
স্থির শ্বেত জ্যোতিঃ হত কপালে উদয় ॥ ৩৬ ॥
ভিতরে ব্যাপার কিবা নাহি যায় বলা ।
জ্যোতিঃ ছটা লইয়া নিদ্রার কালে খেলা ॥ ৩৭ ॥
কখন করেন ছোট কভু বড় তায় ।
আপনার মনোমত আপন ইচ্ছায় ॥ ৩৮ ॥
ক্রমশঃ জ্যোতির রাশি এতই বিস্তার ।
জ্যোতিঃ বিনা কিছু বোধ থাকিত না আর ॥ ৩৯ ॥
নিদ্রার মতন বেগ তার কিছু পরে ।
আপনার সত্তা গত জ্যোতির ভিতরে ॥ ৪০ ॥
নিজে হারা একেবারে তাহায় ডুবিয়া ।
উভয় প্রভেদশূন্য অভেদ হইয়া ॥ ৪১ ॥
শৈশব ছাড়িয়া বয়ঃ যত উর্ধ্বতন ।
অনুরাগসহকারে বিদ্যা উপার্জন ॥ ৪২ ॥
শাস্ত্রগ্রন্থ অধ্যয়ন হয় তার সাথে ।
স্বভাবতঃ রতি মতি ধরমের পথে ॥ ৪৩ ॥
এখানে সেখানে হয় তত্ত্ব অন্বেষণ ।
স্বভাব দেখিয়া তার ভক্ত রাম কন ॥ ৪৪ ॥
আছেন মোদের প্রভু দক্ষিণশহরে ।
উচিত যাইতে তথা দরশন তরে ॥ ৪৫ ॥
উত্তর করিল রামে নরেন্দ্র আপনি ।
কেমন পরমহংস কি প্রকার তিনি ॥ ৪৬ ॥
কহে রাম আপনার চক্ষে না দেখিলে ।
বুঝা নাহি যায় কথা হাজার বুঝালে ॥ ৪৭ ॥
নরেন্দ্র বলেন আগে আমি নাহি যাব ।
জ্ঞান কাকা আছে ঘরে তারে পাঠাইব ॥ ৪৮ ॥
দেখিয়া আসিয়া যদি যাইবারে কয় ।
তা হইলে দরশনে যাইব নিশ্চয় ॥ ৪৯ ॥
এত বলি কাকারে কহিল গিয়া ঘরে ।
কেমন পরমহংস যাও দেখিবারে ॥ ৫০ ॥
সুযোগ বুঝিয়া কাকা একদিন যায় ।
দক্ষিণশহরে প্রভু বিরাজে যথায় ॥ ৫১ ॥
কেমনে বুঝিবে তাঁরে গায়ে কিবা বল ।
মানুষে যেমন বুঝে বুঝিল পাগল ॥ ৫২ ॥
কলুষ-কালিমা-মাখা নর-বুদ্ধি জীবে ।
মায়াধীশ ভগবানে কেমনে বুঝিবে ॥ ৫৩ ॥
বুদ্ধি যেন আপনার দেখিয়া তাঁহারে ।
মন্তব্য নরেন্দ্রে কয় পালটিয়া ঘরে ॥ ৫৪ ॥
ভাল সাধু দেখিবারে মোরে পাঠাইলে ।
কাকার সহিত ব্যঙ্গ অন্যে না পাইলে ॥ ৫৫ ॥
পাগল আচার তাঁর এইক্ষণে খাটে ।
পরক্ষণে অকারণ চলিলেন ছুটে ॥ ৫৬ ॥
দেখিয়া আইনু যাহা আপন নয়নে ।
তাহাতে সাধুত্ব-ভাব নাহি লাগে মনে ॥ ৫৭ ॥
কাকার কথায় কিবা বুঝিলেন তিনি ।
কহিতে নারিনু তত্ত্ব নাহি জানি আমি ॥ ৫৮ ॥
লীলা-দরশনে এই হয় অনুমান ।
সময় হইল এবে শ্রীপ্রভুর টান ॥ ৫৯ ॥
ভক্ত-ভগবানে খেলা নহে বলিবার ।
গোপনে গোপনে বাঁধা সম্বন্ধের তার ॥ ৬০ ॥
মজার ঝঙ্কার তার বাজে প্রাণে প্রাণে ।
হইলে নামের শক্তি সঞ্চালিত কানে ॥ ৬১ ॥
মধুর প্রভুর নাম-প্রভাবের তেজে ।
হৃদি-তন্ত্রী ভকতের মনোহর বাজে ॥ ৬২ ॥
ধরিয়া মোহন নাম ভক্ত মাতোয়ারা ।
দিগাদিগ্ জ্ঞানহত পাগলের পারা ॥ ৬৩ ॥
কার নাম কোথা তিনি দেখিবারে তাঁয় ।
সতত উদ্বিগ্ন-চিত্ত স্বভাবেতে ধায় ॥ ৬৪ ॥
ভক্তেন্দ্র ভকত-শ্রেষ্ঠ নরেন্দ্র উত্তম ।
রামকৃষ্ণপন্থি-মধ্যে আরাধ্য-চরণ ॥ ৬৫ ॥
বিবেক বিরাগ ত্যাগে ভরা হৃদিপুর ।
অতি উগ্র অনুরাগী সন্ন্যাসী ঠাকুর ॥ ৬৬ ॥
কণ্ঠে ভারি মিঠা সুর বর্ষে সুধা-ধারা ।
অন্তে আছে নাদ রাগ রাগিণীর গোড়া ॥ ৬৭ ॥
আধারে অপার গুণ চিত্ত মনোহর ।
পুণ্য-দরশন মূর্তি পরম সুন্দর ॥ ৬৮ ॥
নরবর নরেন্দ্র জনৈক বন্ধু সনে ।
মহানন্দে চলিলেন প্রভু-দরশনে ॥ ৬৯ ॥
এই বন্ধু সুরেন্দ্র অপর কেহ নয় ।
মহাভক্ত শ্রীপ্রভুর গুণের আলয় ॥ ৭০ ॥
পরিচয় নরেন্দ্রের প্রভুর নিকটে ।
সুরেন্দ্র বাখানি কন হৃদি অকপটে ॥ ৭১ ॥
অতি মিঠে কণ্ঠে সুর আছয়ে ইঁহার ।
গাইতে পারেন গীত অতি চমৎকার ॥ ৭২ ॥
রতি-মতি ধর্মপথে তাও বিলক্ষণ ।
সরল হৃদয়ে ধর্মতত্ব-অন্বেষণ ॥ ৭৩ ॥
এইমত গুণ-গাথা বিশেষ করিয়া ।
সুরেন্দ্র কহেন প্রভুদেবে সম্বোধিয়া ॥ ৭৪ ॥
প্রভু যেন অবিদিত কোনই বারতা ।
অবতারে লীলা-খেলা অপরূপ কথা ॥ ৭৫ ॥
নরদেহে নিজে ঢাকা মায়ার সংহতি ।
রোগ-শোক হাসা-কাঁদা আপনা বিস্মৃতি ॥ ৭৬ ॥
ছদ্মবেশে সঙ্গী সনে রঙ্গ-রসাস্বাদ ।
কখন আনন্দ-ভোগ কখন প্রমাদ ॥ ৭৭ ॥
বিদেশীর বেশে ভক্ত চিনিতে না পারে ।
চির চেনা আপনার পরম ঈশ্বরে ॥ ৭৮ ॥
সেই প্রভু সেই ভক্ত নহে স্বতন্তর ।
নিত্যাপেক্ষা লীলা তাঁর বড়ই সুন্দর ॥ ৭৯ ॥
মনোহর চিত্রপট বিচিত্র ধরায় ।
প্রভুর সৃজিত মায়া প্রভুরে ভুলায় ॥ ৮০ ॥
পরমা বিভূতি শক্তিমায়া যাঁরে জানি ।
ব্রহ্মময়ী জড়ময়ী জগত-জননী ॥ ৮১ ॥
শক্তি বিনা নাই লীলা লীলাময়ী নিজে ।
মাতৃরূপে ধরে গর্ভে নারীরূপে ভজে ॥ ৮২ ॥
পঞ্চভূতে গড়া দেহে যেবা বর্তমান ।
এক মায়া সকলের উদ্ভবের স্থান ॥ ৮৩ ॥
বিভুরও এড়ান নাই হোক মায়া তাঁর ।
ধরাধামে আসিবার একই দুয়ার ॥ ৮৪ ॥
মায়ার কেমন খেলা বিভুর উপরে ।
দেখিবার জন্য যার বাসনা অন্তরে ॥ ৮৫ ॥
ভক্তিসহ কর মহাশক্তি আরাধনা ।
প্রসন্না হইলে তবে পুরিবে কামনা ॥ ৮৬ ॥
নরেন্দ্রকে বলিলেন প্রভু ভগবান ।
তোমার সুমিষ্ট কণ্ঠ গাও গুনি গান ॥ ৮৭ ॥
প্রাণ-মন মিষ্ট কণ্ঠ করি একত্তর ।
গাইতে লাগিলা গীত নরেন্দ্র সুন্দর ॥ ৮৮ ॥
গীত শুনি শ্রীপ্রভুর সুখ-সীমা নাই ।
হইলা মগন ভাবে জগৎ-গোসাঁই ॥ ৮৯ ॥
আফুটা-কমল-কলি মধু-কোষে ভরা ।
দেখিয়া যেমন হয় বিভোর ভ্রমরা ॥ ৯০ ॥
প্রবেশিতে কোষমধ্যে প্রমত্ত কেবল ।
হুলে করি বিদারিত সুকোমল দল ॥ ৯১ ॥
সেইমত নরেন্দ্রের হৃদয়-আধার ।
বিবেক বিরাগ জ্ঞান প্রেমের ভাণ্ডার ॥ ৯২ ॥
দেখিয়া প্রভুর তাহে পশিবার মন ।
রঙ্গ-রস-ভঙ্গ-ভয়ে বেগ সংবরণ ॥ ৯৩ ॥
এত ত্বরা দিলে ধরা উচ্চ রস যায় ।
তাই সংবরেন শক্তি প্রভুদেবরায় ॥ ৯৪ ॥
চিরকাল শ্রীপ্রভুর মনচোরা নাম ।
ভক্তিগ্রন্থ পুরাণাদি তাহার প্রমাণ ॥ ৯৫ ॥
মন লয়ে খেলা তাঁর ভক্তগণ সনে ।
কি প্রকার মনে যার সেও নাহি জানে ॥ ৯৬ ॥
নাহি জানে জলাধার দেখিতে না পায় ।
রবি-করে তুলে তারে গগনে খেলায় ॥ ৯৭ ॥
জননী জানেন যেন বিশেষ প্রকার ।
কোন্ দ্রব্য অতিশয় তৃপ্তিকর কার ॥ ৯৮ ॥
যত্ন সহকারে তাঁর ব্যবস্থা তেমন ।
আদরে করাতে প্রিয় নন্দনে ভোজন ॥ ৯৯ ॥
সেইমত প্রভুদেব খুব সুবিদিত ।
কোন্ রসে কার প্রাণ হয় দ্রবীভূত ॥ ১০০ ॥
তাই দিয়া করিতেন এত তুষ্ট মন ।
শ্রীপদে যাহাতে হয় মনের বন্ধন ॥ ১০১ ॥
নরেন্দ্রের সুপ্রশস্ত হৃদয়-নিলয় ।
উচ্চজ্ঞান-প্রেম-ভক্তি-বীজের আশ্রয় ॥ ১০২ ॥
স্তুতি সুমধুর ভাষে প্রভু নারায়ণ ।
অন্তরে পরমানন্দ না যায় বর্ণন ॥ ১০৩ ॥
নরেন্দ্রে বলেন ডাকাইয়া অন্তরালে ।
কে তুমি জান কি এতদিন কোথা ছিলে ॥ ১০৪ ॥
বহুকাল এইখানে হইল যাপন ।
ত্যাগী অনাসক্ত আত্মা তোমার মতন ॥ ১০৫ ॥
না দেখিনু কভু চোখে মম বিদ্যমান ।
নেহারি তোমারে আজি জুড়াইল প্রাণ ॥ ১০৬ ॥
আলোকিত করি দিশি এই মর্ত্য ভূমি ।
আসিয়াছ যেই দিনে তাও জানি আমি ॥ ১০৭ ॥
দিন দিন তিল পল গণিয়া গণিয়া ।
বসিয়া রয়েছি পথপানে নিরখিয়া ॥ ১০৮ ॥
সতত উদ্বিগ্ন চিত পরাণ উদাস ।
আজি সিদ্ধ মনোরথ পূর্ণ মম আশ ॥ ১০৯ ॥
কামিনী-কাঞ্চনাসক্ত মানুষের সনে ।
বাক্যালাপে পাইয়াছি বড় কষ্ট
প্রাণে ॥ ১১০ ॥
আয় আয় কাছে তোর সঙ্গে ক'য়ে কথা ।
করি দূর জীবনের যাবতীয় ব্যথা ॥ ১১১ ॥
নরেন্দ্র ভাবেন শুনি এতেক বচন ।
আমারে এমন কথা কন কি কারণ ॥ ১১২ ॥
মানুষবিশেষ আমি শিমলায় ঘর ।
নরেন্দ্র আমার নাম পিতা বিশ্বেশ্বর ॥ ১১৩ ॥
কি হেতু আমাতে উচ্চ দেবতার মান ।
পাগল শ্রীপ্রভুদেব হইল গিয়ান ॥ ১১৪ ॥
কাকার মন্তব্য সত্য বুঝিয়া নিশ্চয় ।
বন্ধুসহ সেই দিন ফিরিলা আলয় ॥ ১১৫ ॥
বালক নরেন্দ্রনাথ বয়সে কেবল ।
স্বতঃসিদ্ধ মুক্তভাব স্বভাবে প্রবল ॥ ১১৬ ॥
কহি যথাসাধ্য শক্তি শুন বিবরণ ।
সাকার সগুণে তাঁর তুষ্ট নহে মন ॥ ১১৭ ॥
অনাদি অনন্ত ব্রহ্ম অক্ষয় অব্যয় ।
অরূপ অগুণ যাহা বেদান্তেতে কয় ॥ ১১৮ ॥
নাই যাঁর আদি মধ্য অন্ত নিরাকার ।
সেই মাত্র একা সত্য জ্ঞাতব্য সবার ॥ ১১৯ ॥
মিথ্যা বিশ্ব-চরাচর যাহা দৃষ্ট হয় ।
মনের কল্পনা যার সত্য মোটে নয় ॥ ১২০ ॥
বেদান্ত এখন তাঁর নাহি পড়া-শুনা ।
কিন্তু তার সারমর্ম স্বভাবতঃ জানা ॥ ১২১ ॥
অনধীতে শাস্ত্র-তত্ত্ব বিদিত কেমন ।
কলিকায় কুসুমের সৌরভ যেমন ॥ ১২২ ॥
মহাবলী প্রভু-ভক্ত গুণের আধার ।
অন্তরে বাহিরে বহে শ্রীপ্রভুর ধার ॥ ১২৩ ॥
বিচার বিহীনে বস্তু গ্রাহ্য মোটে নয় ।
বিচারে সাব্যস্ত যাহা তাহাই প্রত্যয় ॥ ১২৪ ॥
প্রবীণের জ্ঞান ঘটে নবীন বয়সে ।
সমুজ্জ্বল ছটা তার বদনে বিকাশে ॥ ১২৫ ॥
সর্বদাই সৎ শুদ্ধ বুদ্ধি বিরাজিত ।
দয়া-ভক্তি-প্রেম-ত্যাগ-জ্ঞান-সমন্বিত ॥ ১২৬ ॥
বিকাশে যাইত জানা বিচারের কালে ।
বিভুর বিভূতি যত বুদ্ধি ঘটে খেলে ॥ ১২৭ ॥
সুন্দর বিচার-তর্ক মধুমাখা ভাষ ।
শ্রবণে জনমে হৃদে অপার উল্লাস ॥ ১২৮ ॥
বড় বড় শাস্ত্রবিৎ বুঝিতে না পারে ।
সুনিশ্চিত পরাভূত সম্মুখ সমরে ॥ ১২৯ ॥
স্বভাবে উন্নত মন সুকৌশলবান ।
বীরশ্রেষ্ঠ হাতে ধনু তূণ-পূর্ণ বাণ ॥ ১৩০ ॥
বিচার-সমরক্ষেত্রে যারে আক্রমণ ।
ত্বরায় বিলম্বে কিবা তাহার পতন ॥ ১৩১ ॥
প্রবল যতই যুদ্ধ উচ্চ যত দূর ।
কভু নহে ক্লান্ত কভু না হয় আতুর ॥ ১৩২ ॥
মধুরত্ব তত বাড়ে যত ঊর্ধ্বে গতি ।
সুধামাথা মিষ্ট ভাষাশ্রবণ-পিরীতি ॥ ১৩৩ ॥
বিপরীত গুণ কিবা একাধারে খেলে ।
সময়ে মধুর রস নাহি কোন কালে ॥ ১৩৪ ॥
পরাভূত প্রতিদ্বন্দ্বী তিল নাহি রোধ ।
হারিয়া আশিস করে হইয়া সন্তোষ ॥ ১৩৫ ॥
প্রভুভক্তে শ্রীপ্রভুর এতই বৈভব ।
সহজে সম্পন্ন করে যাহা অসম্ভব ॥ ১৩৬ ॥
সারথি শ্রীপ্রভুদের ভক্ত তাঁর যত ।
এক এক মহারথী পাণ্ডবের মত ॥ ১৩৬ ॥
নরেন্দ্র অর্জুনতুল্য সবার প্রধান ।
নিরন্তর রথে যাঁর প্রভু মূর্তিমান ॥ ১৩৭ ॥
যেমন নরেন্দ্র তেন শ্রীপ্রভু আমার ।
দেখ ভক্ত-ভগবানের রঙ্গ খেলিবার ॥ ১৩৮ ॥
এখন প্রকাশ নতে গোপন গোপন ।
আরম্ভ কেবল এই ভক্তসংজোটন ॥ ১৩৯ ॥
অমাবস্যা-নিশি অতি ঘোর অন্ধকার ।
পবন-নিঃস্বন বৃষ্টি প্রান্তর মাঝার ॥ ১৪০ ॥
বিপন্ন পথিক পথহীন দিশাহারা ।
তার সঙ্গে যেইরূপ চিকুরের ক্রীড়া ॥ ১৪১ ॥
প্রথমে তেমতি খেলা হয় ভক্তসনে ।
অকূল অপার ভবসিন্ধুর তুফানে ॥ ১৪২ ॥
কভু গুপ্ত কভু ব্যক্ত আলোক আঁধারে ।
নিত্যধাম পরিহরি ধরার আসরে ॥ ১৪৩ ॥
যে
রূপে করিলা লীলা লয়ে ভক্তগণ ।
জীবের উদ্ধারে আর শিক্ষার কারণ ॥ ১৪৪ ॥
সেই লীলা-আন্দোলন শ্রবণ-কীর্তনে ।
যে যা চায় তাই পায় যার যেন মনে ॥ ১৪৫ ॥
প্রেমভক্তি পায় স্ফূর্তি দেবেশ বাঞ্ছিত ।
হেন রত্নাকর রামকৃষ্ণ-লীলা-গীত ॥ ১৪৬ ॥
ভগবান বহু বল অঙ্গে দেন যাঁর ।
তাঁহার উপরে পড়ে সেই মত ভার ॥ ১৪৭ ॥
আলোর আকর পূর্ব দীপ্তিমান অতি ।
ধরার চৌদিকে ঘুরে অবিরাম গতি ॥ ১৪৮ ॥
নাহি ক্ষুধা তৃষ্ণা নাই শয্যায় আরাম ।
কর্মমাত্র নানা লোকে আলোক-প্রদান ॥ ১৪৯ ॥
বালক বালার্ক এবে নরেন্দ্র এখানে ।
পাইয়া পরম বল প্রভু-সন্নিধানে ॥ ১৫০ ॥
প্রভু-ভক্তমধ্যে লয়ে সর্বোচ্চ আসন ।
ধরণীর চারিদিক করিয়া ভ্রমণ ॥ ১৫১ ॥
পরিহরি আত্ম-সুখ যশঃ খ্যাতি মান ।
তৃণাপেক্ষা অতি তুচ্ছ করি নিজ প্রাণ ॥ ১৫২ ॥
কেমনে পালন কৈলা কর্তব্য তাঁহার ।
সময়ে অবশ্য মন পাবে সমাচার ॥ ১৫৩ ॥
হৃদয়-আঁধার নাশ শ্রবণ-কীর্তনে ।
উপজে ভকতি প্রভু-ভক্তের চরণে ॥ ১৫৪ ॥
প্রভুদেবে নরেন্দ্রের পাগল গিয়ান ।
কিন্তু শ্রীচরণে স্মৃতি রহে মূর্তিমান ॥ ১৫৫ ॥
কি জানি কি আকর্ষণে উচাটন মন ।
দরখনে হয় আসা এখন তখন ॥ ১৫৬ ॥
এখানে প্রভুর মনে বড়ই উল্লাস ।
ফুটে না উচ্ছ্বাসে ভাসে বদনের ভাষ ॥ ১৫৭ ॥
প্রকাশ করিতে কথা আত্মগণমাঝে ।
এসেছে নরেন্দ্র এক মহাবলী তেজে ॥ ১৫৮ ॥
ভারি জানে লেখা-পড়া পণ্ডিত সুধীর ।
গিয়ানের ছবি যেন তেমতি ভক্তির ॥ ১৫৯ ॥
প্রশস্ত হৃদয়ালয় প্রকাণ্ড আধার ।
কণ্ঠে অতি মিঠা সুর নহে বলিবার ॥ ১৬০ ॥
করিতে করিতে হেন গুণের বাখান ।
সমাধিস্থ হইতেন প্রভু ভগবান ॥ ১৬১ ॥
ঈশ্বরকোটির থাকে যে যে ভক্ত তাঁর ।
প্রধান নরেন্দ্র কেন বলিষ্ঠ সবার ॥ ১৬২ ॥
সম্বন্ধ কিরূপ তাঁর শ্রীপ্রভুর সনে ।
বলিবার নহে বুঝ লীলা-কথা শুনে ॥ ১৬৩ ॥
শ্রীনরেন্দ্র শ্রীপ্রভুর পরান সমান ।
দেখিলে আনন্দ-হারা প্রভু ভগবান ॥ ১৬৪ ॥
রাখিবেন কোনখানে কি দেন খাইতে ।
ঠিক নাই এতদূর যাইতেন মেতে ॥ ১৬৫ ॥
পরদরশন কথা দক্ষিণশহরে ।
বড়ই সুমিষ্ট শুন ভক্তিসহকারে ॥ ১৬৬ ॥
একে সদানন্দ প্রভুদেব ভগবান ।
পাইয়া নরেন্দ্র তাঁয় উঠিল তুফান ॥ ১৬৭ ॥
প্রেমেতে বিহ্বল যেন ভোলা মহেশ্বর ।
অধীর চরণ টলটল কলেবর ॥ ১৬৮ ॥
সমুজ্জ্বল মুখদ্যুতি সুধাংশু লজ্জিত ।
আজানুলম্বিত দীর্ঘ কর প্রসারিত ॥ ১৬৯ ॥
ধরা তাহে রসগোল্লা সঞ্চয় যতনে ।
যথাশক্তি দ্রুতগতি চরণ-চালনে ॥ ১৭০ ॥
ভক্তগত-প্রাণ ভক্ত-প্রিয় ভগবান ।
অতি প্রিয় নরেন্দ্রের মুখে দিতে যান ॥ ১৭১ ॥
প্রভুর অভূতপূর্ব ভাব-দরশনে ।
ভক্তেন্দ্র নরেন্দ্রনাথ বুঝিলেন মনে ॥ ১৭২ ॥
মুখে মিষ্টি দেওয়া নয় কেবল ছলনা ।
উন্মত্ত শ্রীপ্রভু দন্তে দংশন-বাসনা ॥ ১৭৩ ॥
মিষ্টি হাতে অগ্রসর যত প্রভু হন ।
পশ্চাতে নরেন্দ্র তত করে পলায়ন ॥ ১৭৪ ॥
লীলার রহস্য কিবা দেখ নর-কায় ।
অঙ্গ-অংশ নিত্যসিদ্ধ মায়া তবু তাঁয় ॥ ১৭৫ ॥
কেন তাঁর মায়া-ঘোর যুক্ত যেই জন ।
জিজ্ঞাসা করিতে কথা পার তুমি মন ॥ ১৭৬ ॥
উত্তরে তাহার মোর এইমাত্র বলা ।
মায়া না থাকিলে সঙ্গে নাহি হয় খেলা ॥ ১৭৭ ॥
মুক্তাত্মা মায়ায় মুগ্ধ তাহার উপমা ।
বসনে নয়ন বাঁধা শিশু যেন কানা ॥ ১৭৮ ॥
চিনিতে না দেয় মায়া মাত্র আবরণ ।
সেই হেতু ভক্তে রহে মায়ার বন্ধন ॥ ১৭৯ ॥
চিনিলে না হয় লীলা খেলা ভেঙ্গে যায় ।
লীলা ঠিক যাত্রা করা মায়া-বেশ গায় ॥ ১৮০ ॥
যতক্ষণ চলে যাত্রা সাজ বেশ থাকে ।
আজ্ঞাকারী অধিকারী না ছাড়েন তাঁকে ॥ ১৮১ ॥
বেশহীন সবে যবে যাত্রা-সমাপন ।
না রহে আসরে যায় যার যথা মন ॥ ১৮২ ॥
তেন বিমোহিত না থাকিলে ভক্তচয় ।
লীলার আসরে খেলা কখন না হয় ॥ ১৮৩ ॥
একমাত্র লীলা-শক্তি লীলার কারণ ।
তণ্ডুলে না হয় গাছ ধান প্রয়োজন ॥ ১৮৪ ॥
হেন শক্তি মিথ্যা নয় নয় ভ্রান্তি ভুল ।
একভাবে ব্রহ্ম সূক্ষ্ম লীলাভাবে স্থূল ॥ ১৮৫ ॥
স্থূল বিনা সূক্ষ্মে দৃষ্টি না হয় কখন ।
বদন দর্শনোপায় যেমন দর্পণ ॥ ১৮৬ ॥
মায়া লয়ে লীলাখেলা ভক্ত ভগবানে ।
উপলব্ধি হয় লীলা শ্রবণ-কীর্তনে ॥ ১৮৭ ॥
নিত্য যেন তেন লীলা না হয় প্রকাশ ।
কলমে কালিতে তুলে কেবল আভাস ॥ ১৮৮ ॥
গ্রন্থের মধ্যেতে লীলা ফুটে কি রকম ।
মেঘ-অন্তরালে যেন রবির কিরণ ॥ ১৮৯ ॥
দ্বিতীয় যদিও মায়া ভক্তের ভিতরে ।
অনিষ্ট না হয় মায়া রক্ষা করে তাঁরে ॥ ১৯০ ॥
বদ্ধজীবে করে নষ্ট হানে তার প্রাণ ।
প্রভুর দৃষ্টান্তে শুন তাহার প্রমাণ ॥ ১৯১ ॥
মায়া বিড়ালীর জাতি একই দশন ।
মুষিকে ধরিলে পরে বিনাশে জীবন ॥ ১৯২ ॥
সেই দন্তে পুনশ্চ হইলে আবশ্যক ।
ধরিয়া লইয়া যায় আপন শাবক ॥ ১৯৩ ॥
অতি নিরাপদ স্থানে মমতানুরাগে ।
গলায় দাঁতের দাগ আদতে না লাগে ॥ ১৯৪ ॥
ভক্তদের মাতা মায়া সম্পর্ক এমন ।
যাঁরা আছে তাঁরা আছে না হয় নূতন ॥ ১৯৫ ॥
জীবের উদ্ধারে জীবশিক্ষার কারণে ।
রাখেন বিবিধ বেশে নানাবিধ স্থানে ॥ ১৯৬ ॥
মায়ার বাৎসল্য বড় ভক্তের উপর ।
ক্রমশঃ লইয়া যায় আপনার ঘর ॥ ১৯৭ ॥
জীবের গন্তব্য ভক্ত যান যেই দিগে ।
উতরিতে হরিপুর কষ্ট নাহি লাগে ॥ ১৯৮ ॥
দেখাইয়া পথ জীবে করিতে উদ্ধার ।
ভক্ত লয়ে ভগবান হন অবতার ॥ ১৯৯ ॥
হরিপুরে যাইবার যার হবে মন ।
পন্থাহেতু করিবেন লীলা অন্বেষণ ॥ ২০০ ॥
নানা পথ দেখাইলা প্রভু অবতারে ।
নানান ভাবের ভক্ত আনিয়া আসরে ॥ ২০১ ॥
এক এক প্রভু-ভক্ত প্রকটিত রবি ।
প্রত্যেক ভাবের প্রতিমূর্তিমান ছবি ॥ ২০২ ॥
অনন্ত ভাবের ভাবী প্রভু ভাবাকর ।
খেলেছেন কাল মত সাজায়ে আসর ॥ ২০৩ ॥
নানা সেতু কৈলা ভব-নদীর উপরে ।
বিবিধ জীবের জন্য পারে যাইবারে ॥ ২০৪ ॥
নৈয়ায়িক হয় যদি টোলের পণ্ডিত ।
যত ছাত্র সকলেই ন্যায়শাস্ত্রবিৎ ॥ ২০৫ ॥
অপর শাস্ত্রের শিক্ষা সেখানে না মিলে ।
সেরূপ ধরন নহে শ্রীপ্রভুর টোলে ॥ ২০৬ ॥
এক এক মত পথ যত আছে জানা ।
এক এক ছাঁচে গড়া প্রতি ভক্তজনা ॥ ২০৭ ॥
বিশেষতঃ বলীয়ান দীপ্তিমান বেশী ।
কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগে যাঁহারা সন্ন্যাসী ॥ ২০৮ ॥
তাঁদের গন্তব্য পথে গন্তব্য সবার ।
শুন লীলা-গীতি ভক্তি-জ্ঞানের ভাণ্ডার ॥ ২০৯ ॥
প্রভুভক্ত যে সকল সংসারীর বেশে ।
প্রভুর প্রসাদে তাঁরা ন্যূন নন কিসে ॥ ২১০ ॥
তবে কি না সংসারেতে আছে কাদা ঘাঁটা ।
কামিনী ও কাঞ্চনের আসক্তির লেঠা ॥ ২১১ ॥
ঘাঁটিয়া কর্দম পরে ধৌত করা বিধি ।
মঙ্গল কর্দম গায়ে নাহি লাগে যদি ॥ ২১২ ॥
ত্যাগ বিনা জ্ঞান ভক্তি হইবার নয় ।
তাই তিয়াগীর পথে প্রাধান্য নিশ্চয় ॥ ২১৩ ॥
প্রভু অবতারে তাঁর উদ্দেশ্য কেবল ।
যাহাতে জগতে হয় সবার মঙ্গল ॥ ২১৪ ॥
শ্রীকর-কমলে গড়া যত ভক্ত তাঁর ।
তাঁদের দৃষ্টান্তে হবে জীবের উদ্ধার ॥ ২১৫ ॥
পরে পরে পরিচয় পাবে তুমি যন ।
আরম্ভ কেবল এই ভক্ত-সংজোটন ॥ ২১৬ ॥
কোন্
ভক্ত ছিল কোথা কিবা অবস্থায় ।
গৃহী কি সন্ন্যাসী ত্যাগী প্রভুর ইচ্ছায় ॥ ২১৭ ॥
প্রভুদেব কোন্ পথে লয়ে যান কারে ।
অবধান কর মন ভক্তিসহকারে ॥ ২১৮ ॥
নরশ্রেষ্ঠ শ্রীনরেন্দ্র নিজের প্রভুর ।
বিবেকী বিরাগী ত্যাগী সন্ন্যাসী
ঠাকুর ॥ ২১৯ ॥
প্রভুর নিকটে বার বার হয় আসা ।
প্রভুর উপর ক্রমে পড়ে ভালবাসা ॥ ২২০ ॥
আনাগোনা প্রেমে নহে অপর কারণে ।
ধর্মশিক্ষা কিংবা কোন উদ্দেশ্য সাধনে ॥ ২২১ ॥
ঈশ্বরীয় কথা যদি কন ভগবান ।
নরেন্দ্র তাহাতে বড় নাহি দেন কান ॥ ২২২ ॥
একদিন প্রভুদের করিলা জিজ্ঞাসা ।
না শুনিবে তত্ত্ব যদি কিবা হেতু আসা ॥ ২২৩ ॥
উত্তর করিলা তাঁরে প্রেমিক সন্ন্যাসী ।
ভালবাসি সেই হেতু দেখিবারে আসি ॥ ২২৪ ॥
যেমন পশিল কানে প্রেম মাখা বাণী ।
প্রেমেতে প্রফুল্ল মুখ শরদিন্দু জিনি ॥ ২২৫ ॥
বেড়িয়া শ্রীকরদ্বয় করি আলিঙ্গন ।
মহাভাবে প্রভুদেব হইলা মগন ॥ ২২৬ ॥
যেবা করিয়াছে সেই ছবি দরশন ।
বুঝিয়াছে দুইজনে নৈকট্য কেমন ॥ ২২৭ ॥
সাকার সম্বন্ধে প্রভু কন নিরবধি ।
নরেন্দ্র তাহাতে হন ততই বিরোধী ॥ ২২৮ ॥
অখণ্ড সচ্চিদানন্দ অখিল-ঈশ্বর ।
অতি তুচ্ছ পঞ্চভূত খাঁচার ভিতর ॥ ২২৯ ॥
কখন সম্ভব নয় হইতে না পারে ।
মানুষে ঈশ্বরজ্ঞান বলহীনে করে ॥ ২৩০ ॥
কিঞ্চিৎ শকতি যদি কেহ দেখে কার ।
সামান্য বুদ্ধিতে তাঁরে কহে অবতার ॥ ২৩১ ॥
কৃষ্ণ রাম গৌরাঙ্গাদি ভগবান নন ।
তর্কেতে করেন নিজ পক্ষ সমর্থন ॥ ২৩২ ॥
দুগ্ধপোষ্য শিশুসঙ্গে পিতা যে প্রকারে ।
হইয়া শিশুর শিশু মল্লযুদ্ধ করে ॥ ২৩৩ ॥
পরাজিত পরাভূত পতিত ধরায় ।
রঙ্গহেতু হন পিতা আপন ইচ্ছায় ॥ ২৩৪ ॥
ঈশ্বর প্রসঙ্গে তেন হয় দুইজনে ।
হারিয়া আনন্দ বড় শ্রীপ্রভুর মনে ॥ ২৩৫ ॥
প্রভুদেব বলেন নরেন্দ্র নরবর ।
ঘটি-বাটি আপনার সকলই ঈশ্বর ॥ ২৩৬ ॥
নিজ হস্ত নিজ বক্ষে করিয়া স্থাপন ।
দেখাইয়া আপনারে প্রভুদেব কন ॥ ২৩৭ ॥
এ দেহের
তত্ত্ব কিবা এখন না পাবে ।
সময় হইলে পরে আপনি বুঝিবে ॥ ২৩৮ ॥
একদিন প্রভুদেব আপন মন্দিরে ।
নরেন্দ্রের সঙ্গে কথা আনন্দের ভরে ॥ ২৩৯ ॥
কি জানি কি বুঝিলেন প্রভু নারায়ণ ।
আচম্বিতে পরিহরি নিজের আসন ॥ ২৪০ ॥
পরশ করিয়া দিলা আপনার কর ।
প্রিয়জন নরেন্দ্রের বক্ষের উপর ॥ ২৪১ ॥
প্রভুর মহিমা-কথা কহা নাহি যায় ।
বলিতে হইয়া ব্রতী পড়িয়াছি দায় ॥ ২৪২ ॥
ভক্ত লয়ে কিবা লীলা করেন গোসাঁই ।
তিল অণুকণায় আভাস বোধে নাই ॥ ২৪৩ ॥
কথায় কেবল যাহা করিনু শ্রবণ ।
যেমন আমার সাধ্য কহি শুন মন ॥ ২৪৪ ॥
শক্তিময় শ্রীপ্রভুর শ্রীকর-পরশে ।
নরেন্দ্র অবস্থান্তর দেখিছেন বসে ॥ ২৪৫ ॥
উপবিষ্ট যেই ঘরে দিয়াল তাহার ।
ছাদাদি সহিত গেছে কিছু নাই আর ॥ ২৪৬ ॥
একাকার চারিদিকে এক সত্তা ভাসে ।
গুটিয়ে জগৎ যেন তার সঙ্গে মিশে ॥ ২৪৭ ॥
বাখানিয়া উপমায় বলিতে হইলে ।
ঊর্মিময়ী সৃষ্টি যেন ডুবিছে সলিলে ॥ ২৪৮ ॥
প্রলয়েতে যেন এই বিশ্ব চরাচর ।
আদি-অন্ত-বিহীন বিরাট কলেবর ॥ ২৪৯ ॥
অনন্ত অনন্ত কোটি নহে গণনায় ।
যাহাতে উদ্ভব যেন তাহাতে মিলায় ॥ ২৫০ ॥
অথবা যেমন জাল পাতি সূত্রোদর ।
পুনশ্চ গুটিয়ে পুরে পেটের ভিতর ॥ ২৫১ ॥
বিভীষণ প্রলয়ব্যাপার-দরশনে ।
ত্রাসিত নরেন্দ্রনাথ ব্যাকুল পরানে ॥ ২৫২ ॥
কাঁদিতে লাগিলা অতিশয় উচ্চৈঃস্বরে ।
ওগো ওগো মা বাপ আমার আছে ঘরে ॥ ২৫৩ ॥
কাতর দেখিয়া তাঁরে প্রভু নারায়ণ ।
শান্ত করিলেন পুনঃ করি পরশন ॥ ২৫৪ ॥
দেবেশ-বাঞ্ছিত দরশন সমুদায় ।
প্রভুর প্রসাদে ভক্তে অবহেলে পায় ॥ ২৫৫ ॥
এমন ভক্তের পদে রাখি রতি মতি ।
মন দিয়া শুন মন রামকৃষ্ণ-পুঁথি ॥ ২৫৬ ॥