১৮৮৩, ২১শে জুলাই
শ্রীযুক্ত অধর সেনের বাটীতে কীর্তনানন্দে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অধরের বাড়ি আসিয়াছেন। রামলাল, মাস্টার, অধর আর অন্য অন্য ভক্ত তাঁহার কাছে অধরের বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। পাড়ার দু-চারিটি লোক ঠাকুরকে দেখিতে আসিয়াছেন। রাখালের পিতা কলিকাতায় আছেন -- রাখাল সেইখানেই আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (অধরের প্রতি) -- কই রাখালকে খবর দাও নাই?
অধর -- আজ্ঞে হাঁ, তাঁকে খবর দিয়াছি।
রাখালের জন্য ঠাকুরকে ব্যস্ত দেখিয়া অধর দ্বিরুক্তি না করিয়া রাখালকে আনিতে একটি লোক সঙ্গে নিজের গাড়ি পাঠাইয়া দিলেন।
অধর ঠাকুরের কাছে বসিলেন। আজ ঠাকুরকে দর্শনজন্য অধর ব্যাকুল হইয়াছেন। ঠাকুরের এখানে আসিবার কথা পূর্বে কিছু ঠিক ছিল না। ঈশ্বরের ইচ্ছায় তিনি আসিয়া পড়িয়াছেন।
অধর -- আপনি অনেকদিন আসেন নাই। আমি আজ ডেকেছিলাম, -- এমন কি চোখ দিয়ে জল পড়েছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রসন্ন হইয়া, সহাস্যে) -- বল কি গো!
সন্ধ্যা হইয়াছে। বৈঠকখানায় আলো জ্বালা হইল। ঠাকুর জোড় হস্তে জগন্মাতাকে প্রণাম করিয়া নিঃশব্দে বুঝি মূলমন্ত্র করিলেন। তৎপরে মধুর স্বরে নাম করিতেছেন। বলিতেছেন, গোবিন্দ, গোবিন্দ, সচ্চিদানন্দ, হরিবোল! হরিবোল! নাম করিতেছেন, আর যেন মধু বর্ষণ হইতেছে। ভক্তেরা অবাক্ হইয়া সেই নাম-সুধা পান করিতেছেন। শ্রীযুক্ত রামলাল এইবার গান গাইতেছেন:
ভুবন
ভুলাইলি মা,
হরমোহিনী।
মূলাধারে
মহোৎপলে,
বীণাবাদ্য-বিনোদিনী।
শরীর শারীর
যন্ত্রে
সুষুম্নাদি
ত্রয় তন্ত্রে,
গুণভেদ মহামন্ত্রে
গুণত্রয়বিভাগিনী
৷৷
আধারে ভৈরবাকার
ষড়দলে
শ্রীরাগ আর,
মণিপুরেতে
মহ্লার, বসন্তে
হৃৎপ্রকাশিনী
বিশুদ্ধ
হিল্লোল সুরে,
কর্ণাটক
আজ্ঞাপুরে,
তান লয় মান সুরে, তিন
গ্রাম-সঞ্চারিণী।
মহামায়া
মোহপাশে, বদ্ধ
কর অনায়াসে,
তত্ত্ব লয়ে
তত্ত্বাকাশে
স্থির আছে
সৌদামিনী।
শ্রীনন্দকুমারে
কয়, তত্ত্ব না
নিশ্চয় হয়,
তব তত্ত্ব
গুণত্রয়,
কাকীমুখ-আচ্ছাদিনী।
রামালাল আবার গাইলেন:
ভবদারা
ভয়হরা নাম
শুনেছি তোমার,
তাইতে এবার দিয়েছি
ভার তারো তারো
না তারো মা।
তুমি মা
ব্রহ্মাণ্ডধারী
ব্রহ্মাণ্ড
ব্যাপিকে,
কে জানে তোমারে
তুমি কালী কি
রাধিকে,
ঘটে ঘটে তুমি ঘটে
আছ গো জননী,
মূলাধার
কমলে থাক মা
কুলকুণ্ডলিনী।
তদূর্ধ্বেতে
আছে মাগো নামে
স্বাধিষ্ঠান,
চতুর্দল
পদ্মে তথায় আছ
অধিষ্ঠান,
চর্তুদলে থাক তুমি
কুলকুণ্ডলিনী,
ষড়দল বজ্রাসনে বস
মা আপনি।
তদূর্ধ্বেতে
নাভিস্থান মা
মণিপুর কয়,
নীলবর্ণের
দশদল পদ্ম যে
তথায়,
সুষুম্নার পথ
দিয়ে এস গো জননী,
কমলে কমলে থাক কমলে
কামিনী।
তদূর্ধ্বেতে
আছে মাগো সুধা
সরোবর,
রক্তবর্ণের
দ্বাদশদল
পদ্ম মনোহর,
পাদপদ্মে দিয়ে যদি এ
পদ্ম প্রকাশ।
(মা), হৃদে আছে
বিভাবরী
তিমির বিনাশ।
তদূর্ধ্বেতে
আছে মাগো নাম
কণ্ঠস্থল,
ধূম্রবর্ণের
পদ্ম আছে হয়ে
ষোড়শদল।
সেই পদ্ম মধ্যে
আছে অম্বুজে
আকাশ,
সে আকাশ রুদ্ধ
হলে সকলি আকাশ।
তদূর্ধ্বে
ললাটে স্থান
মা আছে দ্বিদল
পদ্ম,
সদায় আছয়ে মন হইয়ে
আবদ্ধ।
মন যে মানে না আমার
মন ভাল নয়,
দ্বিদলে
বসিয়া রঙ্গ
দেখয়ে সদায়।
তদূর্ধ্বে
মস্তকে স্থান
মা অতি মনোহর,
সহস্রদল পদ্ম আছে
তাহার ভিতর।
তথায় পরম শিব আছেন
আপনি,
সেই শিবের কাছে বস
শিবে মা আপনি।
তুমি আদ্যাশক্তি
মা জিতেন্দ্রিয়
নারী,
যোগীন্দ্র
মুনীন্দ্র
ভাবে নগেন্দ্র
কুমারী।
হর শক্তি হর
শক্তি সুদনের
এবার,
যেন না আসিতে হয়
মা ভব পারাবার।
তুমি আদ্যাশক্তি
মাগো তুমি
পঞ্চতত্ত্ব,
কে জানে তোমারে
তুমি তুমিই
তত্ত্বাতীত।
ওমা ভক্ত জন্য
চরাচরে তুমি
সে সাকার,
পঞ্চে পঞ্চ লয় হলে
তুমি নিরাকার।
[নিরাকার সচ্চিদানন্দ দর্শন -- ষট্চক্রভেদ -- নাদভেদ ও সমাধি ]
শ্রীযুক্ত রামলাল যখন গাহিতেছেন:
“তদূর্ধ্বেতে
আছে মাগো নাম
কণ্ঠস্থল,
ধূম্রবর্ণের
পদ্ম আছে হয়ে
ষোড়শদল।
সেই পদ্ম মধ্যে
আছে অম্বুজে
আকাশ,
সে আকাশ রুদ্ধ
হলে সকলি আকাশ।”
তখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারকে বলিতেছেন --
“এই শুন, এরই নাম নিরাকার সচ্চিদানন্দ-দর্শন। বিশুদ্ধচক্র ভেদ হলে সকলি আকাশ।”
মাস্টার -- আজ্ঞে হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ -- এই মায়া-জীব-জগৎ পার হয়ে গেলে তবে নিত্যতে পৌঁছানো যায়। নাদ ভেদ হলে তবে সমাধি হয়। ওঁকার সাধন করতে করতে নাদ ভেদ হয়, আর সমাধি হয়।