২০ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে
দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২৫শে মে
বিজয়াদি ভক্তসঙ্গে সংকীর্তনানন্দে — সহচরীর গৌরাঙ্গসন্ন্যাস গান
কীর্তনী গৌরসন্ন্যাস গাইতেছেন ও মাঝে মাঝে আখর দিতেছেন —
(নারী
হেরবে না!) (সে
যে সন্ন্যাসীর
ধর্ম!)
(জীবের দুঃখ
ঘুচাইতে,)
(নারী হেরিবে
না!)
(নইলে বৃথা গৌর
অবতার!)
ঠাকুর গৌরাঙ্গের সন্ন্যাস কথা শুনিতে শুনিতে দণ্ডায়মান হইয়া সমাধিস্থ হইলেন। অমনি ভক্তেরা গলায় পুষ্পমালা পরাইয়া দিলেন। ভবনাথ, রাখাল, ঠাকুরকে ধারণ করিয়া আছেন — পাছে পড়িয়া যান। ঠাকুর উত্তরাস্য, বিজয়, কেদার, রাম, মাস্টার, মনোমোহন। লাটু প্রভৃতি ভক্তেরা মণ্ডলাকার করিয়া তাঁহাকে ঘেরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। সাক্ষাৎ গৌরাঙ্গ কি আসিয়া ভক্তসঙ্গে হরিণাম-মহোৎসব করিতেছেন!
[শ্রীকৃষ্ণই অখন্ড সচ্চিদানন্দ — আবার জীব-জগৎ — স্বরাট্বিরাট্ ]
অল্পে অল্পে সমাধি ভঙ্গ হইতেছে। ঠকুর সচিদানন্দ কৃষ্ণের সহিত কথা কহিতেছেন। ‘কৃষ্ণ’ এই কথা এক-একবার উচ্চারণ করিতেছেন, আবার এক-একবার পারিতেছেন না। বলিতেছেন — কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ, সচ্চিদাননদ! — কই তোমার রূপ আজকাল দেখি না! এখন তোমায় অন্তরে বাহিরে দেখছি — জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব — সবই তুমি! মন বুদ্ধি সবই তুমি! গুরুর প্রণামে আছে —
অখণ্ডমণ্ডলাকারং
ব্যাপ্তং যেন
চরাচরম্।
তৎপদং
দর্শিতং যেন তস্মৈ
শ্রীগুরবে
নমঃ।
“তুমিই অখণ্ড, তুমিই আবার চরাচর ব্যাপ্ত করে রয়েছ! তুমিই আধার। তুমিই আধেয়! প্রাণকৃষ্ণ! মনকৃষ্ণ! বুদ্ধিকৃষ্ণ! আত্মাকৃষ্ণ! প্রাণ হে গোবিন্দ মম জীবন!”
বিজয়ও আবিষ্ট হইয়াছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, “বাবু, তুমিও কি বেহুঁশ হয়েছ?”
বিজয় (বিনীতভাবে) — আজ্ঞা, না।
কীর্তনী আবার গাইতেছেন — “আঁধল প্রেম!” কীর্তনী যাই আখর দিলেন — “সদাই হিয়ার মাঝে রাখিতাম, ওহে প্রাণবঁধু হে!” ঠাকুর আবার সমাধিস্থ! — ভবনাথের কাঁধে ভাঙা হাতটি রহিয়াছে!
কিঞ্চিৎ বাহ্য হইলে, কীর্তনী আবার আখর দিতেছেন — “যে তোমার জন্য সব ত্যাগ করেছে তার কি এত দুঃখ?”
ঠাকুর কীর্তনীকে নমস্কার করিলেন। বসিয়া গান শুনিতেছেন — মাঝে মাঝে ভাবাবিষ্ট। কীর্তনী চুপ করিলেন। ঠাকুর কথা কহিতেছেন।
[প্রেমে দেহ ও জগৎ ভুল — ঠাকুরের ভক্তসঙ্গে নৃত্য ও সমাধি ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয় প্রভৃতি ভক্তের প্রতি) — প্রেম কাকে বলে। ঈশ্বরে যার প্রেম হয় — যেমন চৈতন্যদেবের — তার জগৎ তো ভুল হয়ে যাবে, আবার দেহ যে এত প্রিয়, এ পর্যন্ত ভুল হয়ে যাবে!
প্রেম হলে কি হয়, ঠাকুর গান গাইয়া বুঝাইতেছেন।
হরি
বলিতে ধারা
বেয়ে পড়বে।
(সে দিন কবে বা
হবে)
(অঙ্গে
পুলক হবে)
(সংসার বাসনা
যাবে)
(দুর্দিন
ঘুচে সুদিন
হবে) (কবে হরির
দয়া হবে)
ঠাকুর দাঁড়াইয়াছেন ও নৃত্য করিতেছেন। ভক্তেরা সঙ্গে সঙ্গে নাচিতেছেন। ঠাকুর মাস্টারের বাহু আকর্ষণ করিয়া মণ্ডলের ভিতর তাঁহাকে লইয়াছেন।
নৃত্য করিতে করিতে আবার সমাধিস্থ! চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া। কেদার সমাধী ভঙ্গ করিবার জন্য স্তব করিতেছেন —
“হৃদয়কমলমধ্যে
নির্বিশেষং
নিরীহম্
হরিহরবিধিবেদ্যং
যোগিভির্ধ্যানগম্যম্।
জননমরণভীতিভ্রংশি
সচ্চিৎস্বরূপম্,
সকল ভুবনবীজং
ব্রহ্মচৈতন্যমীড়ে ॥”
ক্রমে সমাধি ভঙ্গ হইল। ঠাকুর আসন গ্রহণ করিলেন ও নাম করিতেছেন — ওঁ সচ্চিদানন্দ! গোবিন্দ! গোবিন্দ! গোবিন্দ! যোগমায়া! — ভাগবত-ভক্ত-ভগবান!
কীর্তন ও নৃত্যস্থলের ধূলি ঠাকুর লইতেছেন।