২৮ শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৭ই সেপ্টেম্বর


ভক্তসঙ্গে সংকীর্তনানন্দে — ভক্তসঙ্গে নৃত্য

ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিয়াছেন। সম্প্রদায় লইয়া শ্যামদাস মাথুর কীর্তন গাইতেছেন:

“নাথ দরশসুখে ইত্যাদি —

“সুখময় সায়র, মরুভূমি ভেল। জলদ নেহারই, চাতকী মরি গেল।”

শ্রীমতীর এই বিরহদশা বর্ণনা শুনিয়া ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। তিনি ছোট খাটটির উপর নিজের আসনে, বাবুরাম, নিরঞ্জন, রাম, মনোমোহন, মাস্টার, সুরেন্দ্র, ভবনাথ প্রভৃতি ভক্তরা মেঝেতে বসিয়া আছেন। কিন্তু গান ভাল জমিতেছে না।

কোন্নগরের নবাই চৈতন্যকে ঠাকুর কীর্তন করিতে বলিলেন। নবাই মনোমোহনের পিতৃব্য। পেনশন লইয়া কোন্নগরে গঙ্গাতীরে ভজন-সাধন করেন। ঠাকুরকে প্রায় দর্শন করিতে আসেন।

নবাই উচ্চ সংকীর্তন করিতেছেন। ঠাকুর আসন ত্যাগ করিয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন। অমনি নবাই ও ভক্তেরা তাঁহাকে বেড়িয়া বেড়িয়া নৃত্য ও কীর্তন করিতে লাগিলেন। কীর্তন বেশ জমিয়া গেল। মহিমাচরণ পর্যন্ত ঠাকুরের সঙ্গে নৃত্য করিতেছেন।

কীর্তনান্তে ঠাকুর নিজের আসনে উপবেশন করিলেন। হরিনামের পর এবার আনন্দময়ী মায়ের নাম করিতেছেন। ঠাকুর ভাবে মত্ত হইয়া মার নাম করিতেছেন। নাম করিবার সময় ঊর্ধ্বদৃষ্টি।

গান   —   গো আনন্দময়ী হয়ে মা আমায় নিরানন্দ করো না।

গান   —   ভাবিলে ভাবের উদয় হয়!
যেমন ভাব, তেমনি লাভ, মূল সে প্রত্যয়।
যে-জন কালীর ভক্ত জীবন্মুক্ত নিত্যানন্দময় ॥
কালীপদ সুদাহ্রদে চিত্ত যদি রয়।
পূজা হোম জপ বলি কিছুই কিছু নয় ॥

গান   —   তোদের খ্যাপার হাট বাজার মা (তারা)।
কব গুণের কথা কার মা তোদের ॥
গজ বিনে গো আরোহণে ফিরিস কদাচার।
মণি-মুক্তা ফেলে পরিস গলে নরশির হার ॥
শ্মশানে-মশানে ফিরিস কার বা ধারিস ধার।
রামপ্রসাদকে ভবঘোরে করতে হবে পার ॥

গান   —   গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায়।
কালী কালী বলে আমার অজপা যদি ফুরায় ॥

গান   —   আপনাতে আপনি থেকো মন, যেও নাকো কারু ঘরে।
যা চাবি তাই বসে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে ॥

গান   —   মজলো আমার মনভ্রমরা শ্যামাপদ নীলকমলে।

গান   —   যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণি শ্যামা মাকে।
মন তুই দেখ, আর আমি দেখি, আর যেন কেউ নাহি দেখে ॥

ঠাকুর এই গানটি গাইতে গাইতে দণ্ডায়মান হইলেন। মার প্রেমে উন্মত্তপ্রায়! ‘আদরিণী শ্যামা মাকে হৃদয়ে রেখো।’ — এ-কথাটি যেন ভক্তদের বারবার বলিতেছেন।

ঠাকুর এইবার যেন সুরাপানে মত্ত হইয়াছেন। নাচিতে নাচিতে আবার গান গাহিতেছেন:

            মা কি আমার কালো রে।
কালোরূপ দিগম্বরী, হৃদিপদ্ম করে আলো রে!

ঠাকুর গাইতে গাইতে বড় টলিতেছেন দেখিয়া নিরঞ্জন তাঁহাকে ধারণ করিতে গেলেন। ঠাকুর মৃদুস্বরে “য়্যাই! শালা ছুঁসনে” বলিয়া বারণ করিতেছেন। ঠাকুর নাচিতেছেন দেখিয়া ভক্তেরা দাঁড়াইলেন। ঠাকুর মাস্টারের হস্ত ধারণ করিয়া বলিতেছেন, “য়্যাই শালা নাচ।”

[বেদান্তবাদী মহিমার প্রভুসঙ্গে সংকীর্তনে নৃত্য ও ঠাকুরের আনন্দ ]

ঠাকুর নিজের আসনে বসিয়া আছেন। ভাবে গরগর মাতোয়ারা!

ভাব কিঞ্চিৎ উপশম হইলে বলিতেছেন — ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ কালী। আবার বলিতেছেন, তামাক খাব। ভক্তেরা অনেকে দাঁড়াইয়া আছেন। মহিমাচরণ দাঁড়াইয়া ঠাকুরকে পাখা করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি) — আপনারা বোসো।

“আপনি বেদ থেকে একটু কিছু শুনাও।

মহিমাচরণ আবৃত্তি করিতেছেন — ‘জয় জজ্বমান’ ইত্যাদি।

আবার মহানির্বাণতন্ত্র হিতে স্তব আবৃত্তি করিতেছেন —

ওঁ নমস্তে সতে তে জগৎকারণায়, নমস্তে চিতে সর্বলোকাশ্রয়ায়।
নমোঽদ্বৈততত্ত্বায় মুক্তিপ্রদায়, নমো ব্রহ্মণে ব্যাপিনে শাশ্বতায় ॥
ত্বমেকং শরণ্যং ত্বমেকং বরেণ্যং, ত্বমেকং জগৎপালকং স্বপ্রকাশম্‌।
ত্বমেকং জগৎকতৃপাতৃপ্রহর্তৃ, ত্বমেকং পরং নিশ্চলং নির্বিকল্পম্‌ ॥
ভয়ানাং ভয়ং ভীষণং ভীষণানাং, গতিঃ প্রাণিনাং পাবণং পাবনানাম্‌।
মহোচ্চৈঃপদানাং নিয়ন্তৃ ত্বমেকং, পরেষাং পরং রক্ষণং রক্ষণানাম্‌ ॥
বয়ন্ত্বাং সমরামো বয়ন্ত্বান্‌ভজামো, বয়ন্ত্বাং জগৎসাক্ষিরূপং নমামঃ।
সদেকং নিধানং নিরালম্বমীশং, ভবাম্ভোধিপোতং শরণ্যং ব্রজামঃ ॥

ঠাকুর হাতজোড় করিয়া স্তব শুনিলেন। পাঠান্তে ভক্তিভরে নমস্কার করিলেন। ভক্তেরাও নমস্কার করিলেন।

অধর কলিকাতা হইতে আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — আজ খুব আনন্দ হল! মহিম চক্রবর্তী এদিকে আসছে। হরিনামে আনন্দ কেমন দেখলে! না?

মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ।

মহিমাচরণ জ্ঞানচর্চা করেন। তিনি আজ হরিনাম করেছেন, আর কীর্তনসময়ে নৃত্য করিয়াছেন — তাই ঠাকুর আহ্লাদ করিতেছেন।

সন্ধ্যা আগতপ্রায়। ভক্তেরা অনেকেই ক্রমে ক্রমে ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।