৪৩ বসু বলরাম-মন্দিরে, গিরিশ-মন্দিরে ও দেবেন্দ্র-ভবনে ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

১৮৮৫, ১১ই মার্চ

রাজপথে শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত ঈশ্বরাবেশ

গিরিশের নিমন্ত্রণ! রাত্রেই যেতে হবে। এখন রাত ৯টা, ঠাকুর খাবেন বলে রাত্রের খাবার বলরামও প্রস্তুত করেছেন। পাছে বলরাম মনে কষ্ট পান, ঠাকুর গিরিশের বাড়ি যাইবার সময় তাই বুঝি বলিতেছেন, “বলরাম! তুমিও খাবার পাঠিয়ে দিও।”

দুতলা হইতে নিচে নামিতে নামিতেই ভগবদ্ভাবে বিভোর! যেন মাতাল। সঙ্গে নারাণ ও মাস্টার। পশ্চাতে রাম, চুনি ইত্যাদি অনেকে। একজন ভক্ত বলিতেছেন, “সঙ্গে কে যাবে?” ঠাকুর বলিলেন, “একজন হলেই হল।” নামিতে নামিতেই বিভোর। নারাণ হাত ধরিতে গেলেন, পাছে পড়িয়া যান। ঠাকুর বিরক্তি প্রকাশ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে নারাণকে সস্নেহে বলিলেন, “হাত ধরলে লোকে মাতাল মনে করবে, আমি আপনি চলে যাব।”

বোসপাড়ার তেমাথা পার হচ্ছেন — কিছুদূরেই শ্রীযুক্ত গিরিশের বাড়ি। এত শীঘ্র চলছেন কেন? ভক্তেরা পশ্চাতে পড়ে থাকছে। না জানি হৃদয়মধ্যে কি অদ্ভুত দেবভাব হইয়াছে! বেদে যাঁহাকে বাক্য-মনের অতীত বলিয়াছেন, তাঁহাকে চিন্তা করিয়া কি ঠাকুর পাগলের মতো পাদবিক্ষেপ করিতেছেন? এইমাত্র বলরামের বাড়িতে বলিলেন যে, সেই পুরুষ বাক্য-মনের অতীত নহেন; তিনি শুদ্ধমনের, শুদ্ধবুদ্ধির, শুদ্ধ আত্মার গোচর। তবে বুঝি সেই পুরুষকে সাক্ষাৎকার করছেন! এই কি দেখছেন — “যো কুছ হ্যায়, সো তুঁহি হ্যায়?”

এই যে নরেন্দ্র আসিতেছেন। ‘নরেন্দ্র’ ‘নরেন্দ্র’ বলিয়া পাগল। কই, নরেন্দ্র সম্মুখে আসিলেন, ঠাকুর তো কথা কহিতেছেন না। লোকে বলে, এর নাম ভাব, এইরূপ কি শ্রীগৌরাঙ্গের হইত?

কে এ-ভাব বুঝিবে? গিরিশের বাড়ি প্রবেশ করিবার গলির সম্মুখে ঠাকুর আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সঙ্গে ভক্তগণ। এইবার নরেন্দ্রকে সম্ভাষণ করিতেছেন।

নরেন্দ্রকে বলছেন, “ভাল আছ, বাবা? আমি তখন কথা কইতে পারি নাই।” — কথার প্রতি অক্ষর করুণা মাখা। তখনও দ্বারদেশে উপস্থিত হন নাই। এইবার হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িলেন।

নরেন্দ্রের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, একটা কথা — এই একটি (দেহী?) ও একটি (জগৎ?)।

জীব জগৎ! ভাবে এ-সব কি দেখিতেছিলেন? তিনিই জানেন, অবাক্‌ হয়ে কি দেখছিলেন! দু-একটি কথা উচ্চারিত হইল, যেন বেদবাক্য — যেন দৈববানী — অথবা, যেন অনন্ত সমুদ্রের তীরে গিয়াছি ও অবাক্‌ হয়ে দাঁড়াইয়াছি; আর যেন অনন্ততরঙ্গমালোত্থিত অনাহত শব্দের একটি-দুটি ধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল।