স্বামী বিবেকানন্দ
(সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত লিখিত)
(উদ্বোধন ১লা শ্রাবণ, ১৩১২)

আমি তখন হাবড়াতে এক খুল্লতাত-গৃহে থেকে এন্ট্রান্স দ্বিতীয় কি প্রথম শ্রেণীতে পড়ছিলাম। খুড়ো মশায়ের কাছে ইংরেজী বাঙলা কাগজ আসত। আমি বাল্যকাল থেকেই সংবাদপত্র-ভক্ত ছিলাম। পড়লাম, “আমাদের নরেন্দ্রনাথ ফিরে এসেছেন। দিগ্বিজয় করে সনাতন ধর্মকে পাশ্চাত্য জগতে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে স্বদেশের ধন মাতৃ ক্রোড়ে ফিরে এসেছেন।” ঐদিন থেকে আমি প্রতিদিন প্রতি সংযোগে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনকাহিনী জানবার জন্য উৎসুক হলাম। তখন বালক ছিলাম, তাই তিনি কি করেছেন না করেছেন, কি জয় করেছেন, কি প্রতিষ্ঠা করেছেন, এই সব জানবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ না করে কেবল তাঁর জীবনের ঘটনাবলী জানবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। আমি বাল্যের ঐ শুভ মুহূর্তকে, ঐ ব্যাকুলতাপূর্ণ শুভ আগ্রহকে এখনো প্রতিদিন ভক্তিপূরিত নয়ন-জলে স্মরণপথে এনে থাকি।

সেইদিন থেকে স্বামীজীকে আমি জানি। কলেজে পড়তে আরম্ভ করে স্বামীজীর সম্বন্ধে আরও অনেক কথা জানতে লাগলাম। এখন যতই দিন যাচ্ছে — তাঁর সেই তেজোময় চক্ষু, ততই যেন আমার চক্ষের উপরে প্রতি মূহূর্তে বিভাসিত হয়ে উঠছে। প্রতি মুহূর্তে যেন দেখছি, অনতিদূরে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্ব দিকে অঙ্গুলি নির্দেশপূর্বক প্রেমের রবে জগৎবাসিগণকে ডাকছেন — সেই ঋষিকণ্ঠ-মুখোরিত চিরপুরাতন বাণী তাঁর মুখে যেন আবার নবীনতর হয়ে উঠেছে:

“ভাইসব, ওঠ, জাগ, আর ঘুমিও না! মৃত্যু তো দিন দিন কাছে আসছে।”

কলেজে পড়তে আরম্ভ করে তাঁকে দেখবার জন্য ব্যাকুল হলাম। বেলুড় মঠের দিকে ছুটতাম। আমার বলবার চাইবার বিশেষ কিছু ছিল না। নিজের ক্ষুদ্রত্ব উপলব্ধি করে শুধু শুনবার জন্য নম্রহৃদয়ে বসতাম। মঠের অন্যান্য সাধুগণ — যাঁদের পবিত্র জীবন, জলন্ত স্বার্থত্যাগ এবং ধর্ম ও কর্মনিষ্ঠা আজও শত শত জনকে ঐ মঠের দিকে দ্বিগুণতর বেগে আকর্ষণ করছে — সকলেই বসতেন। কত লোক আসতেন, কত কথা হতো, ঐসব দিনের কথা মনে হলে যেন এক স্বপ্নরাজ্যে চলে যাই। সকলে মুগ্ধ হয়ে, যেন এক নতুন সম্পত্তির অধিকারী হয়ে প্রেমপূর্ণ মুখে উঠে যেতেন। আর বাক্য নেই! আর ক্ষুদ্র কথা নেই! সকলেই নীরব, চিন্তাশীল। আমি তো অতশত কিছু বুঝতাম না। শুধু শুনতাম — আর মাঝে মাঝে তীব্র বৈরাগ্যের বাণী হৃদয়ে উপলব্ধি করে — যেমন আবালবদ্ধ সকলেরই কোন কোন শুভ মুহূর্তে হয়ে থাকে — আমার হৃদয় জেগে উঠত, চোখে জল আসত।

এইরূপ সকাল-সন্ধ্যায় অনেকদিন আনন্দপূর্ণ হৃদয়ে মঙ্গল ইচ্ছাগুলি প্রাণে নিয়ে জাহ্নবী পার হয়ে কলকাতায় ফিরতাম। এভাবে আমি স্বামীজীকে জানি। অথবা তাঁর সম্বন্ধে কিছু জানি না বলাই ভাল।

একদিন বিভিন্ন কলেজের কয়েকজন যুবক-বন্ধুর সঙ্গে স্বামীজীর কাছে বেলুড় মঠে গিয়েছিলাম। কত কথা হচ্ছে। প্রশ্ন করা মাত্র আর কথা নেই, অমনি মুহূর্তমধ্যে most conclusive জবাব দিচ্ছেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, “তোরা তো কত European philosophy, metaphysics পড়ছিস, কত কত দেশের নতুন নতুন কাহিনী জানছিস, আমাকে বল দেখি — what is the grandest of all the truths in life?"

আমরা মনে করলাম, তিনি না জানি কি প্রশ্ন করেছেন। সকলেই উত্তরবিমুখ, ভাবতে লাগলাম না জানি কি উত্তর তিনি অপেক্ষা করছেন। অমনি বহ্নিপূর্ণ ভাষায় বলে উঠলেন:

“দেখ শোন, we shall all die — আমরা সকলেই মরব। প্রতিদিন এইকথা মনে রাখিস, তবেই প্রাণ জেগে উঠবে। তবেই নীচাশয়তা দূর হয়ে যাবে, কার্যে সক্ষম হবি, শরীর-মন সবল হবে। আর তোদের সংস্পর্শে যারা আসবে, তারা সকলেই তোদের কাছ থেকে কিছু পাবে।”

আমি অমনি বলে উঠলাম, “স্বামীজী! মৃত্যুর কথা মনে এলে তো হৃদয় ভেঙে পড়বে, নিরাশা এসে হৃদয়কে অধিকার করবে।”

স্বামীজী — তুই ঠিক বলেছিস, প্রথমে হৃদয় ভেঙে পড়বে, নিরাশা আসবে বটে। কিন্তু, যাক না দ-দশ দিন। তারপর? তারপর দেখবি হৃদয়ে জোর এসেছে, মৃত্যু চিন্তা সর্বদা হৃদয়ে থেকে তোদের নবীন জীবন দান করছে। প্রতি মূহূর্তে রক্তমাংসের নশ্বরতা জানিয়ে দিয়ে তোকে চিন্তাশীল করে তুলছে। দুদিন থাক, দুমাস-দুবছর থাক, দেখবি তাই সিংহবিক্রমে জেগে উঠছিস। ক্ষুদ্র শক্তি মহৎ শক্তি হয়ে উঠেছে। মৃত্যুচিন্তা কর দেখি — দেখবি, তোরা নিজেরাই উপলব্ধি করাব। কথায় আমি আর কি বোঝাব!

কোন এক বন্ধু, নম্রভাবে স্বামীজীর গুণানুবাদ করতে লাগলেন।

স্বামীজী — আমাকে প্রশংসা করিস না। জগতে প্রশংসা-নিস্তার কোন মূল্য নেই। মানুষকে দোলাতে নাচায় মাত্র। প্রশংসা বহুৎ পেয়েছি। গালিবর্ষণও কম হয়নি। ওসব দিকে তাকিয়ে আমার কি হবে। সকলেই নিজ নিজ কাজ কর। দিন আসলেই আমি, তুই সব মিলিয়ে যাব। কাজ করতে এসেছি, ডাক পড়লেই তুই আমি চলে যাব।

আমি — আমরা কত ক্ষুদ্র — স্বামীজী।

স্বামীজী — ঠিক বলেছিস তুই, ঠিক বলেছিস! এই যে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড, কোটি কোটি সৌরমণ্ডলের কথা একবার চিন্তা করে দেখ দেখি — কি এক অনন্ত শক্তিতে প্রবুদ্ধ হয়ে এ জগৎ যেন কার চরণে ছুটে চলেছে, আমরা কত ক্ষুদ্র, ভাব দেখি। এখানে কি আমাদের ক্ষুদ্রতা নীচাশয়তাকে প্রশ্রয় দিতে আছে? এখানে কি শত্রুতা দলাদলি করতে আছে? তোরা সব কলেজ থেকে বেরিয়ে শব্দ পরসেবায় লেগে যা দেখি? আমার কথা বিশ্বাস কর, টাকা পয়সায় পর্ণে ভাণ্ডারের বোঝা নিয়ে যত সুখ না পাবি, তার চেয়ে অনেক আনন্দ পাবি, একদিকে পরসেবা করবি অপর দিকে জ্ঞানের পথে অগ্রসর হবি।

আমি বললাম, “আমরা যে বড় দরিদ্র স্বামীজী!”

স্বামীজী — রেখে দে দারিদ্র্য! তুই কিসে দরিদ্র বল দেখি? তোর জুড়ি-গাড়ি নেই তাই দুঃখ করছিস? আরে তুই পায়ে হেঁটে দিনরাত খেটে যে সব কাজ করে যাবি! ঐ দেখ জীবন-জাহ্নবীর পরপার দেখা যাচ্ছে — ঐ দেখ মরণের পরদা খুলে গেছে! তোরা কী এক অমৃত রাজ্যের অধিকারী!

আমি৷ আপনার কাছে বসলে আমাদের কথা বলতে ইচ্ছা করে না — শুধু শুনি।

স্বামীজী — দেখ, এই যে কত বছর ভারতের নানাদেশ ঘুরেছি — কত হৃদয়বান মানুষ দেখেছি। কত কত মহাপুরুষ দেখেছি, তাঁদের কাছে বসলে হৃদয়ে এক অদ্ভুত শক্তি আসত, তারই জোরে তোদের দই এক কথা বলছি মাত্র, আমাকে তোরা একটা মস্ত কিছু ভাবিস না।

আমি — আমরা মনে করি, আপনি ভগবানকে পেয়েছেন।

যেই এই কথা বললাম, এখনো আমার সেই আবর্ণ-বিস্তৃত জলপূর্ণ চক্ষু, মনে পড়ে — অমনি প্রেমপর্ণ হৃদয়ে আস্তে আস্তে বলে উঠলেন:

“ঐ চরণে জ্ঞানিগণের জ্ঞানের সার্থকতা। ঐ চরণে প্রেমিকের প্রেমের সার্থকতা। কোথায় যাবে জগতের নরনারী — ঐ চরণে আসতেই হবে।”

কিছুক্ষণ পরে বলতে লাগলেন:

“জগতের মানুষগুলি পাগলামি করে সমস্ত দিন মারামারি কাটাকাটি করছে! সারাটা দিন কি আর এইভাবে চলে? সন্ধ্যায় মায়ের কোলে আসতেই হবে।”

এইরূপে বেলুড়ের পুণ্য মঠে কতদিন গিয়েছিলাম, স্বামীজীর কত কথাই শুনেছিলাম! জাপান যাবার উদ্যোগ হচ্ছে, শরীরও পূর্বাপেক্ষা সুস্থ হচ্ছে, এমন সময় হঠাৎ ৫ জুলাই প্রাতঃকালে কি এক নিদারূণ বাণী পৌঁছল, “স্বামী বিবেকানন্দ ইহলোকে নেই।”...

তিলক ‘কৈশরী' পত্রিকায় লিখেছিলেন: “স্বামী বিবেকানন্দ বর্তমান সময়ে ভারতে দ্বিতীয় শঙ্কর ছিলেন।”

এ ব্রহ্মাণ্ডে কত নর নারী, আসছে, যাচ্ছে। অনন্ত কাল প্রবাহে নবীন পরাতন হচ্ছে, পরোতন নবীন হবে, যেসব মহাপুরুষের জীবন শত শত ভ্রান্ত ও ক্লান্তজনকে কঠোর জীবনপথে চলবার আশা ও বল দিয়ে যাচ্ছেন:

"Well have they lived, who leave the world bestowing upon posterity a hallowed name."

অথবা তোমার জন্য, আমরা দুঃখ করবই বা কেন? তুমি তো চলে যাওনি অতি নিকটে রয়েছ —

তুমি,

Ah! you who turned the spirit's mystic tide
And gave new life-blood into foreign lands
Thy country's hero and thy nation's pride.
Oh! hear the prayers she weeping upwards sends,
And take the offering from her trembling hands.