৬ শ্রীযুক্ত কেশবচন্দ্র সেনের সহিত
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নৌকাবিহার,
আনন্দ ও কথোপকথন
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
১৮৮২, ২৭শে অক্টোবর
ত্রিভির্গুণয়ৈর্ভাবৈরেভিঃ
সর্বমিদং জগৎ ৷
মোহিতং
নাভিজানাতি মামেভ্যঃ
পরমব্যয়ম্ ৷৷
[গীতা — ৭।১৩]
এ সংসার কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবাদির প্রতি) — বন্ধন আর মুক্তি — দুয়ের কর্তাই তিনি। তাঁর মায়াতে সংসারী জীব কামিনী-কাঞ্চনে বদ্ধ, আবার তাঁর দয়া হলেই মুক্ত। তিনি “ভববন্ধনের বন্ধনহারিণী তারিণী”।
এই বলিয়া গন্ধর্বনিন্দিতকন্ঠে রামপ্রসাদের গান গাহিতেছেন:
শ্যামা
মা উড়াচ্ছ
ঘুড়ি (ভবসংসার
বাজার মাঝে) ৷
(ওই যে)
আশা-বায়ু ভরে
উড়ে, বাঁধা
তাহে মায়া দড়ি ॥
কাক
গণ্ডি মণ্ডি
গাঁথা, পঞ্জরাদি
নানা নাড়ী ৷
ঘুড়ি
স্বগুণে
নির্মাণ করা,
কারিগরি
বাড়াবাড়ি ॥
বিষয়ে
মেজেছ মাঞ্জা,
কর্কশা হয়েছে
দড়ি ৷
ঘুড়ি
লক্ষের
দুটা-একটা
কাটে, হেসে
দাও মা হাত-চাপড়ি ॥
প্রসাদ
বলে, দক্ষিণা
বাতাসে ঘুড়ি
যাবে উড়ি ৷
ভবসংসার
সমুদ্রপারে
পড়বে গিয়ে
তাড়াতাড়ি ॥
“তিনি লীলাময়ী! এ-সংসার তাঁর লীলা। তিনি ইচ্ছাময়ী, আনন্দময়ী। লক্ষের মধ্যে একজনকে মুক্তি দেন।”
ব্রাহ্মভক্ত — মহাশয়, তিনি তো মনে করলে সকলকে মুক্ত করতে পারেন। কেন তবে আমাদের সংসারে বদ্ধ করে রেখেছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁর ইচ্ছা। তাঁর ইচ্ছা যে, তিনি এইসব নিয়ে খেলা করেন। বুড়ীকে আগে থাকতে ছুঁলে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। সকলেই যদি ছুঁয়ে ফেলে, খেলা কেমন করে হয়? সকলেই ছুঁয়ে ফেললে বুড়ি অসন্তুষ্ট হয়। খেলা চললে বুড়ীর আহ্লাদ। তাই “লক্ষের দুটো-একটা কাটে, হেসে দাও মা হাত-চাপড়ি।” (সকলের আনন্দ)
“তিনি মনকে আঁখি ঠেরে ইশারা করে বলে দিয়েছেন, ‘যা, এখন সংসার করগে যা।’ মনের কি দোষ? তিনি যদি আবার দয়া করে মনকে ফিরিয়া দেন, তাহলে বিষয়বুদ্ধির হাত থেকে মুক্তি হয়। তখন আবার তাঁর পাদপদ্মে মন হয়।”
ঠাকুর সংসারীর ভাবে মার কাছে অভিমান করে গাইতেছেন:
আমি
ওই খেদ খেদ
করি ৷
তুমি
মাতা থাকতে
আমার জাগা ঘরে
চুরি ॥
মনে
করি তোমার নাম
করি, কিন্তু
সময়ে পাসরি ৷
আমি বুঝেছি
জেনেছি, আশয়
পেয়েছি এ-সব
তোমারি চাতুরী ॥
কিছু
দিলে না, পেলে
না, নিলে না,
খেলে না, সে
দোষ কি আমারি ৷
যদি
দিতে পেতে,
নিতে খেতে,
দিতাম
খাওয়াতাম
তোমারি ॥
যশ,
অপযশ, সুরস,
কুরস সকল রস
তোমারি ৷
(ওগো)
রসে থেকে
রসভঙ্গ, কেন
কর রসেশ্বরী ॥
প্রসাদ
বলে, মন দিয়েছ,
মনেরি আঁখি
ঠারি ৷
(ওমা) তোমার সৃষ্টি
দৃষ্টি-পোড়া,
মিষ্টি বলে ঘুরি ॥
“তাঁরই মায়াতে ভুলে মানুষ সংসারী হয়েছে। ‘প্রসাদ বলে মন দিয়েছে, মনেরি আঁখি ঠারি’।”
[কর্মযোগ সম্বন্ধে শিক্ষা — সংসার ও নিষ্কামকর্ম ]
ব্রাহ্মভক্ত — মহাশয়, সব ত্যাগ না করলে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে না?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — নাগো! তোমাদের সব ত্যাগ করতে হবে কেন? তোমরা রসে-বসে বেশ আছ। সা-রে-মা-তে! (সকলের হাস্য) তোমরা বেশ আছ। নক্স খেলা জানো? আমি বেশি কাটিয়ে জ্বলে গেছি। তোমরা খুব সেয়ানা। কেউ দশে আছো; কেউ ছয়ে আছো; কেউ পাঁচে আছো। বেশি কাটাও নাই; তাই আমার মতো জ্বলে যাও নাই। খেলা চলছে — এ তো বেশ। (সকলের হাস্য)
“সত্য বলছি, তোমরা সংসার করছ এতে দোষ নাই। তবে ঈশ্বরের দিকে মন রাখতে হবে। তা না হলে হবে না। একহাতে কর্ম কর, আর-একহাতে ঈশ্বরকে ধরে থাক। কর্ম শেষ হলে দুইহাতে ঈশ্বরকে ধরবে।
“মন নিয়ে কথা। মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত। মন যে-রঙে ছোপাবে সেই রঙে ছুপবে। যেমন ধোপাঘরের কাপড়। লালে ছোপাও লাল, নীলে ছোপাও নীল, সবুজ রঙে ছোপাও সবুজ। যে-রঙে ছোপাও সেই রঙেই ছুপবে। দেখ না, যদি একটু ইংরেজী পড়, তো অমনি মুখে ইংরেজী কথা এসে পড়ে। ফুট-ফাট, ইট-মিট্। (সকলের হাস্য) আবার পায়ে বুটজুতা, শিস দিয়ে গান করা; এই সব এসে জুটবে। আবার যদি পণ্ডিত সংস্কৃত পড়ে অমনি শোলোক ঝাড়বে। মনকে যদি কুসঙ্গে রাখ তো সেরকম কথাবার্তা, চিন্তা হয়ে যাবে। যদি ভক্তের সঙ্গে রাখ, ঈশ্বরচিন্তা, হরি কথা — এই সব হবে।
“মন নিয়েই সব। একপাশে পরিবার, একপাশে সন্তান। একজনকে একভাবে, সন্তানকে আর-একভাবে আদর করে। কিন্তু একই মন।”