২৮ শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

নবম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ১৪ই সেপ্টেম্বর


নরেন্দ্রের ভক্তি — যদু মল্লিকের বাগানে ভক্তসঙ্গে শ্রীগৌরাঙ্গের ভাব

অপরাহ্ন হইয়াছে। বেলা ৫টা হইবে। ঠাকুর গাত্রোত্থান করিলেন। ভক্তেরা বাগানে বেড়াইতেছেন। অনেকে শীঘ্র বিদায় লইবেন।

ঠাকুর উত্তরের বারান্দায় হাজরার সহিত কথা কহিতেছেন। নরেন্দ্র আজকাল গুহদের বড়ছেলে অন্নদার কাছে প্রায় যান।

হাজরা — গুহদের ছেলে অন্নদা, শুনলাম বেশ কঠোর করছে। সামান্য সামান্য কিছু খেয়ে থাকে। চারদিন অন্তর অন্ন খায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — বল কি? ‘কে জানে কোন্‌ ভেক্‌সে নারায়ণ মিল্‌ যায়।’

হাজরা — নরেন্দ্র আগমনী গাইলে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্যস্ত হইয়া) — কিরকম?

কিশোরী কাছে দাঁড়াইয়া। ঠাকুর বলছেন, তুই ভাল আছিস?

ঠাকুর পশ্চিমের গোল বারান্দায়। শরৎকাল। গেরুয়া রঙে ছোপানো একটি ফ্লানেলের জামা পরিতেছেন ও নরেন্দ্রকে বলছেন, “তুই আগমনী গেয়েছিস?” গোল বারান্দা হইতে নামিয়া নরেন্দ্রের সঙ্গে গঙ্গার পোস্তার উপর আসিলেন। সঙ্গে মাস্টার। নরেন্দ্র গান গাহিতেছেন:

কেমন করে পরের ঘরে, ছিলি উমা বল মা তাই।
কত লোকে কত বলে, শুনে প্রাণে মরে যাই ॥
চিতাভস্ম মেখে অঙ্গে, জামাই বেড়ায় মহারঙ্গে।
তুই নাকি মা তারই সঙ্গে, সোনার অঙ্গে মাখিস ছাই ॥
কেমন মা ধৈর্য ধরে, জামাই নাকি ভিক্ষা করে।
এবার নিতে এলে পরে, বলব উমা ঘরে নাই ॥

ঠাকুর দাঁড়াইয়া শুনিতেছেন। শুনিতে শুনিতে ভাবাবিষ্ট।

এখনও একটু বেলা আছে। সূর্যদেব পশ্চিম গগনে দেখা যাইতেছেন। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট। তাঁহার একদিকে উত্তরবাহিনী গঙ্গা — কিয়ৎক্ষণ হইল জোয়ার আসিয়াছে। পশ্চাতে পুষ্পোদ্যান। ডানদিকে নবত ও পঞ্চবটী দেখা যাইতেছে। কাছে নরেন্দ্র দাঁড়াইয়া গান গাহিতেছেন।

সন্ধ্যা হইল। নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তেরা প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিয়াছেন। ঘরে ঠাকুর আসিয়াছেন ও জগন্মাতার নাম ও চিন্তা করিতেছেন।

শ্রীযুক্ত যদু মল্লিক পার্শ্বের বাগানে আজ আসিয়াছেন। বাগানে আসিলে প্রায় ঠাকুরকে লোক পাঠাইয়া লইয়া যান — আজ লোক পাঠাইয়াছেন — ঠাকুরের যাইতে হইবে। শ্রীযুক্ত অধর সেন কলিকাতা হইতে আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন।

[ভক্তসঙ্গে শ্রীযুক্ত যদু মল্লিকের বাগানে — শ্রীগৌরাঙ্গ ভাব ]

ঠাকুর শ্রীযুক্ত যদু মল্লিকের বাগানে যাইবেন। লাটুকে বলিতেছেন, লণ্ঠটা জ্বাল্‌, একবার চল্‌।

ঠাকুর লাটুর সঙ্গে একাকী যাইতেছেন। মাস্টার সঙ্গে আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — তুমি নারাণকে আনলে না কেন?

মাস্টার বলিতেছেন — আমি কি সঙ্গে যাব?

শ্রীরামকৃষ্ণ — যাবে? অধর-টধর সব রয়েছে — আচ্ছা, এসো।

মুখুজ্জেরা পথে দাঁড়াইয়াছিলেন। ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন — ওঁরা কেউ যাবেন? (মুখুজ্জেদের প্রতি) — আচ্ছা, বেশ চলো। তাহলে শীঘ্র উঠে আসতে পারব।

[চৈতন্যলীলা ও অধরের কর্মের কথা যদু মল্লিকের সঙ্গে ]

ঠাকুর যদু মল্লিকের বৈঠকখানায় আসিয়াছেন। সুসজ্জিত বৈঠকখানা। ঘর বারান্দায় দ্যালগিরি জ্বলিতেছে। শ্রীযুক্ত যদুলাল ছোট ছোট ছেলেদের লইয়া আনন্দে দু-একটি বন্ধুসঙ্গে বসিয়া আছেন। খানসামারা কেহ অপেক্ষা করিতেছে, কেহ হাতপাখা লইয়া পাখা করিতেছে। যদু হাসিতে হাসিতে বসিয়া বসিয়া ঠাকুরকে সম্ভাষণ করিলেন ও অনেকদিনের পরিচিতের ন্যায় ব্যবহার করিতে লাগিলেন।

যদু গৌরাঙ্গভক্ত। তিনি স্টার থিয়েটারে চৈতন্যলীলা দেখিয়া আসিয়াছেন। ঠাকুরের কাছে গল্প করিতেছেন। বলিলেন, চৈতন্যলীলা নূতন অভিনয় হইতেছে। বড় চমৎকার হইয়াছে।

ঠাকুর আনন্দের সহিত চৈতন্যলীলা-কথা শুনিতেছেন। মাঝে মাঝে যদুর একটি ছোট ছেলের হাত লইয়া খেলা করিতেছেন। মাস্টার ও মুখুজ্জে-ভ্রাতারা তাঁহার কাছে বসিয়া আছেন।

শ্রীযুক্ত অধর সেন কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়ারম্যান-এর কর্মের জন্যে চেষ্টা করিয়াছিলেন। সে কর্মের মাহিনা হাজার টাকা। অধর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট — তিনশ টাকা মাইনে পান। অধরের বয়স ত্রিশ বৎসর।

শ্রীরামকৃষ্ণ (যদুর প্রতি) — কই অধরের কর্ম হল না?

যদু ও তাঁহার বন্ধুরা বলিলেন, অধরের কর্মের বয়স যায় নাই।

কিয়ৎক্ষণ পরে যদু বলিতেছেন — “তুমি একটু তাঁর নাম করো।”

ঠাকুর গৌরাঙ্গের ভাব গানের ছলে বলিতেছেন:

গান   —   আমার গৌর নাচে।
নাচে সংকীর্তনে, শ্রীবাস-অঙ্গনে, ভক্তগণসঙ্গে ॥ 

গান   —   আমার গৌর রতন।

গান   —   গৌর চাহে বৃন্দাবনপানে, আর ধারা বহে দুনয়নে।
(ভাব হবে বইকি রে) (ভাবনিধি শ্রীগৌরাঙ্গের)
(ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়) (বন দেখে বৃন্দাবন ভাবে)
(সমুদ্র দেখে শ্রীযমুনা ভাবে) (গৌর আপনার পায় আপনি ধরে)
(যার অন্তঃ কৃষ্ণ বহিঃ গৌর)

গান   —   আমার অঙ্গ কেন গৌর, (ও গৌর হল রে!)