প্রথম খণ্ড
শ্রীপ্রভুর জন্মকথা
জয়
জয় রামকৃষ্ণ বাঞ্ছাকল্পতরু ।
জয় জয় ভগবান জগতের গুরু ॥
জয় জয় রামকৃষ্ণ ইষ্টগোষ্ঠীগণ ।
সবার চরণরেণু মাগে এ অধম ॥
হুগলি জেলায় গ্রাম কামারপুকুর ।
সৎ
দ্বিজকুলে জন্ম হৈল শ্রীপ্রভুর ॥ ১ ॥
চাটুয্যে শ্রীখুদিরাম জনক তাঁহার ।
তেজস্বী ব্রাহ্মণ অতি শুদ্ধ নিষ্ঠাচার ॥ ২ ॥
জাতিগত কর্ম যাহা সব আচরণ ।
রূপ তপ
ধ্যান পূজা তীর্থপর্যটন ॥ ৩ ॥
হইলে দূরস্থ তীর্থ নির্ভন্ন অন্তর ।
পায়ে হেঁটে
যান সেতুবন্ধ রামেশ্বর ॥ ৪ ॥
ন্যায়পরায়ণ তেঁহ ধার্মিক সুধীর ।
রামভক্ত শালগ্রাম
ঘরে রঘুবীর ॥ ৫ ॥
আর দুটি ঠাকুরের ঘরেতে বিরাজ ।
একটি শীতলামাতা অন্য ধর্মরাজ
॥ ৬ ॥
মূর্তিত্রয়ে পূজিবারে বড়ই পিরীত ।
সিদ্ধবাক্ দ্বিজবর দেশেতে খেয়াতি ॥ ৭ ॥
নানান কাহিনী তাঁর নানা জনে রটে ।
আজ্ঞায় বেলার গাছে নিত্য ফুল ফুটে ॥ ৮ ॥
প্রতিদিন প্রত্যুষেতে পূজার কারণে ।
বাহির হইলে তেঁহ কুসুম-চয়নে ॥ ৯ ॥
পশ্চাতে পশ্চাতে তাঁর যাইয়ে আপনি ।
আরাধ্যা শীতলামাতা বালিকারূপিণী ॥ ১০ ॥
আভরণে শোভে অঙ্গ পরিধেয় লাল ।
সুয়ায়ে ধরিত দ্বিজে কুসুমের ডাল ॥ ১১ ॥
যে ডালে অনেক ফুল আছয়ে ফুটিয়া ।
তুলিতেন দ্বিজবর আনন্দে পুরিয়া ॥ ১২ ॥
ব্রহ্মশক্তি-পরিপূর্ণ তেজপুঞ্জ কার ।
দেখিলেই শ্রদ্ধা-ভক্তি আপনি উজার ॥ ১৩ ॥
নির্ধন যদিও তাঁর ঘরে নাই অর্থ ।
সম্মুখে দাঁড়াতে কারো না ছিল সামর্থ্য ॥ ১৪
॥
যে
পুকুরে নিতি নিতি হ'ত স্নান তাঁর ।
তাঁর আগে নামে জলে সাধ্য নাই কা'র ॥ ১৫ ॥
নিষ্ঠাচারে বড় আঁটা তেজস্বী ব্রাহ্মণ ।
শূদ্রদত্ত দ্রব্য নহে কখন গ্রহণ ॥ ১৬
॥
গেরুয়া বসনপরা গম্ভীর আকার ।
কোন কালে নহে যাওয়া ঘরে যার তার ॥ ১৭ ॥
গ্রামে জানে
পদ-রজে ব্যাধিনাশ হয় ।
পরশিতে পদদ্বয় কাঁপিত হৃদয় ॥ ১৮ ॥
গ্রাম-পথে যেতে নত লোক
সারি সারি ।
গললগ্নবাস লুটে দোকানী পসারী ॥ ১৯ ॥
এদিকে দয়াল হৃদি অতি মিষ্টভাষী ।
উদ্বার সরল সমন্বিত গুণরাশি ॥ ২০ ॥
নিজে যেন সেই মত ভার্যা গুণবতী ।
মূর্তিমতী দয়া যেন গঠন আকৃতি ॥ ২১ ॥
ক্ষুধার্ত
যে কেহ গিয়া দাঁড়ালে দুয়ারে ।
যতনে দিতেন তিনি যা থাকিত ঘরে ॥ ২২ ॥
অন্তরেতে সরলতা এত দীপ্তিমান ।
উত্তর পূরব কিছু না ছিল গেয়ান ॥ ২৩ ॥
অবিদিত সাত পাঁচ পরহিতে রত ।
নিরুপম অলৌকিক গুণ কব কত ॥ ২৪ ॥
সামান্যা নহেন ইনি ব্রাহ্মণের ঘরে ।
ভূভার-হরণ প্রভু ধরেন উদরে ॥ ২৫ ॥
প্রভুর জননী হন আমাদের আই ।
অতঃপর এই আখ্যা দিয়া তাঁরে গাই ॥ ২৬ ॥
কোটি কোটি দণ্ডবৎ আইর চরণে ।
আক্ষেপ বড়ই তাঁয় না দেখি নয়নে ॥ ২৭ ॥
গলবাস করজোড়ে সকলের আগে ।
আইর চরণরেণু অভাগিয়া মাগে ॥ ২৮ ॥
তাঁহার ভাগ্যের কথা না যায় বাখানি ।
তিন পুত্র প্রসবেন আই ঠাকুরানী ॥ ২৯ ॥
শ্রীরামকুমার আগে, মাঝে রামেশ্বর ।
সবার কনিষ্ঠ প্রভু করুণা সাগর ॥ ৩০ ॥
কন্যাদ্বয় মধ্যে দেবী কাত্যায়নী জ্যেষ্ঠা ।
সর্বমঙ্গলা দেবী তাঁহার কনিষ্ঠা ॥ ৩১ ॥
জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীরামের অক্ষয় নন্দন ।
কৈশোর বয়সে দেহ ছাড়িল জীবন ॥ ৩২ ॥
মধ্যমের দুই পুত্র একটি নন্দিনী ।
রামলাল, শিবরাম, লক্ষ্মী ঠাকুরানী ॥ ৩৩ ॥
এই কয় মাত্র দেখি ইষ্টপরিবার ।
অসংখ্য প্রণাম করি শ্রীপদে সবার ॥ ৩৪ ॥
আইর যে গর্ভে জন্ম লইলেন প্রভু ।
আশ্চর্য কাহিনী হেন নাহি শুনি কভু ॥ ৩৫ ॥
একবার পিতা তাঁর গয়াধামে যান।
তথায় কিবা শুনহ আখ্যান ॥ ৩৬ ॥
একদিন দ্বিজবর দেখেন স্বপন ।
অতি সুমধুর কথা
আশ্চর্য কখন ॥ ৩৭ ॥
শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম চতুর্ভুজধারী ।
শ্যাামল উজ্জ্বল কার করজোর
করি ॥ ৩৮ ॥
পুত্র হ'য়ে জনমিব তোমার আগারে ।
হাসিয়া হাসিয়া কথা কন দ্বিজবরে ॥ ৩৯ ॥
উত্তরে কহেন দ্বিজ ওরে বাছাধন ।
কি গাওয়াব তোরে আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ ॥ ৪০॥
পুনশ্চ মুরতি কহে ব্রাহ্মণের ঠাঁই ।
আমার পোষণে ভার চিন্তা কিছু নাই ॥ ৪১ ॥
এত বলি নিমিষের মধ্যে অন্তর্ধান ।
অদর্শনে
ব্রাহ্মণের আকুল পরাণ ॥ ৪২ ॥
নিদ্রা-ভঙ্গে উঠিলেন ব্রাহ্মণ চমকি ।
এ ঘোর রজনীযোগে
একি রূপ দেখি ॥ ৪৩ ॥
আপনার মনে দ্বিজ করিয়া বিচার ।
অবগত হইলেন মর্ম কি ইহার ॥ ৪৪ ॥
হেথা আই ঠাকুরানী আপন ভবনে ।
কহিতেছিলেন কথা নারীত্রয় সনে ॥ ৪৫॥
শিবের মণ্ডপ এক
আছিল অদূরে ।
বেখিলেন আসে কিবা বায়ুরূপাকারে ॥ ৪৬ ॥
আসিয়া প্রবেশ কৈল গর্ভেতে
তাঁহার।
ভয়ার্ত হইল আই দেখিয়া ব্যাপার ॥ ৪৭ ॥
যে তিন নারীর সঙ্গে কথা হ'তেছিল ।
আই ঠাকুরানী তত্ত্ব ভাঙ্গিয়া কহিল ॥ ৪৮ ॥
নানা জনে নানা মতে নানা কথা কহে ।
অবাক
হইয়া আই দাঁড়াইয়া রহে ॥ ৪৯ ॥
নারীত্রয় মধ্যে এক ধনী কামারিনী ।
পশ্চাৎ গাইব আমি
তাঁহার কাহিনী ॥ ৫০ ॥
অতি ভাগ্যবতী এই কামারের মেয়ে ।
থাকিলে নিতাম তাঁর পদরজ
গিয়ে ॥ ৫১ ॥
প্রভুতে বাৎসল্য বড় আছিল তাঁহার ।
কত ভাগ্য এ সৌভাগ্য ঘটয়ে কাহার ॥ ৫২ ॥
ভুবনপাবন যিনি বাঞ্ছাকল্পতরু ।
অনাথের নাথ যিনি জগতের গুরু ॥ ৫৩ ॥
সম্বোধন করিতেন
তাঁহারে মা বলি ।
এ অভাগা মাগে হেন জন পদধূলি। ॥ ৫৪ ॥
বিচার না করি কিছু
জাতিকুলাচার ।
রামকুকে যেবা 'বাসে পুজ্য সে সবার ॥ ৫৫ ॥
ব্রাহ্মণ হইয়া যদি প্রভুদ্বেষী হয় ।
চণ্ডাল হইতে নীচ মম মনে লয় ॥ ৫৬ ॥
গয়াধাম হইতে চাটুয্যে মহাশয় ।
করম সমাধা করি ফিরিলা আলয় ॥ ৫৭ ॥
সব নিবেদিলা তাঁরে আই ঠাকুরানী ।
যে দিনে যেখানে যাহা দেখিলেন তিনি ॥ ৫৮ ॥
স্বপনের কথা দ্বিজ স্মরিয়া অন্তরে ।
আইরে কহেন কথা না কবে কাহারে ॥ ৫৯ ॥
দিন দিন যায় যত গর্ভ তত বাড়ে ।
কান্তি দেখে অপরের ভ্রান্তি হয় তাঁরে ॥ ৬০ ॥
আইর লাবণ্যচ্ছটা অতি অপরূপ ।
স্বরূপ ঘুচিয়া হইল স্বরূপ স্বরূপ ॥ ৬১ ॥
স্বভাব হৈল যেন ঠিক পাগলিনী ।
দেখে শুনে প্রতিবাসী করে কানাকানি ॥ ৬২ ॥
যেরূপ রূপের ছটা গর্ভিণীর গায় ।
বোধ হয় ব্রহ্মদৈত্য পেয়েছে উহায় ॥ ৬৩ ॥
কেহ কয় বহু বয়ঃ গর্ভ তায় হ'ল ।
বাঁচে কি না বাঁচে বুঝি এইবার গেল ॥ ৬৪ ॥
আইও কেমন হৈলা ভূতে পাওয়া মত ।
কখনও উল্লাস ত্রাস কথা নানা মত ॥ ৬৫ ॥
কখনও বলেন তিনি হৃদি অকপটে ।
পতিস্পর্শে গর্ভ নয় কি ঢুকেছে পেটে ॥ ৬৬ ॥
দেখেন শুনেন কত গর্ভ-অবস্থায় ।
অতি অসম্ভব কথা কহনে না যায় ॥ ৬৭ ॥
গর্ভ-অবস্থার কথা সুন্দর ভারতী ।
দেখেন কতই দেব-দেবীর মুরতি ॥ ৬৮ ॥
তিন চার মাস গর্ভ আইর যখন ।
একদিন ঘটে এক অদ্ভুত ঘটন ॥ ৬৯ ॥
অলসে অবশ তনু শুইয়া দুয়ারে ।
কপাট করিয়া বন্ধ আপনার ঘরে ॥ ৭০ ॥
হেনকালে শুনিলেন আই ঠাকুরানী ।
রুনুঝুনু নূপুরের সুমধুর ধ্বনি ॥ ৭১ ॥
কুতূহলে যত আই কান পাতি শুনে ।
ততই নূপুর বাদ্য বাজে ঘনে ঘনে ॥ ৭২ ॥
আশ্চর্য গণিয়া আই ভাবে মনে মন ।
নূপুরের বাদ্য ঘরে হয় কি কারণ ॥ ৭৩ ॥
কপাট করেছি বন্ধ শূন্য ঘর দেখি ।
বুঝি মোর অগোচরে কেহ গেছে ঢুকি ॥ ৭৪ ॥
এত ভাবি
কপাট খুলিয়া দেখে আই ।
ঠিক সেই শূন্য ঘর কেহ কোথা নাই ॥ ৭৫ ॥
কারে কিছু না কহিয়া
মৌন হয়ে রন ।
স্বামীরে কহিলা ঘরে আইলা যখন ॥ ৭৬ ॥
নূপুরের বাদ্য ঘরে কি কারণ হয় ।
বুঝি না কি হেতু, তাই হয়েছে বিস্ময় ॥ ৭৭ ॥
ব্রাহ্মণ বুঝিল তত্ত্ব ভার্যার কথায় ।
লয়ে তাঁরে সংগোপনে কতই বুঝায় ॥ ৭৮ ॥
এ অতি মঙ্গল কথা না করিবে ভয় ।
হইবে গোকুলচাঁদ ভবনে উদ্বয় ॥ ৭৯ ॥
আর দিন নিদ্রাযোগে দেখেন স্বপন ।
কি সুন্দর শিশু কোলে করে আরোহণ ॥ ৮০ ॥
বুকে উঠে ছোট হাতে গলা ছেঁদে ধরে ।
জিনি শশী রূপরাশি সুহাসি অধরে ॥ ৮১ ॥
অস্পষ্ট কতই কথা ধীরে ধীরে বলি ।
অবশেষে বুক হ'তে পড়িল পিছলি ॥ ৮২ ॥
অমনি চমকি আই জাগিয়া উঠিলা ।
কোথা গেলি বলি আই কাঁদিতে লাগিলা ॥ ৮৩ ॥
স্বপনের কথা
পরে বুঝিয়া আপনে ।
সংবরিলা আঁখিজল আপন নয়নে ॥ ৮৪ ॥
কত কি দেখেন আই কব আমি ক'টা ।
ঘরের ভিতরে কোটি বিজলীর ছটা ॥ ৮৫ ॥
কোন দিন পাইতেন চন্দনের বাস ।
চন্দনের কাঠে
যেন নির্মিত আবাস ॥ ৮৬ ॥
কোন দিন দিব্য গন্ধ পাইতেন ঘরে ।
যেন কত পদ্মবন ঘেরা
চারি ধারে॥ ৮৭ ॥
এইরূপে আট নয় দশ মাস গত ।
আইর প্রসবকাল হৈল উপস্থিত ॥ ৮৮ ॥
প্রহরেক বেলা যাবে, ঠাকুরানী কন ।
বড়ই আসিছে মোর প্রসব-বেদন ॥ ৮৯ ॥
শুনিয়া চাটুষ্যে কন ইহা কও কিবা ।
এখন না হ'ল ঘরে রঘুবীর-সেবা ॥ ৯০ ॥
ঠাকুরের ভোগ রাগ হয়ে গেলে সব ।
তখন হইবে তুমি দিনান্তে প্রসব ॥ ৯১ ॥
যথা কথা দ্বিজ-আজ্ঞা দিবা অবসান ।
সন্ধ্যাকালে দ্বিতীয়ার চাঁদ দীপ্তিমান ॥ ৯২ ॥
প্রসবের স্থান নির্ধারিত ঢেঁকিশালে ।
প্রসব হইল আই কুশলে কুশলে ॥ ৯৩ ॥
সন বার বিয়াল্লিশ ছয়ই১ ফাল্গুনে ।
শুরু পক্ষ বুধবার দ্বিতীয়া সে দিনে ॥ ৯৪ ॥
রবি বৃষ চন্দ্র গ্রহ শুভ লগ্নে ধরি ।
ভূমিতলে অবর্তীর্ণ গোলকবিহারী ॥ ৯৫ ॥
রঙ্গময় রঙ্গপ্রিয় রঙ্গের কারণ ।
বারে বারে হয় তাঁর মর্ত্যে আগমন ॥ ৯৬ ॥
জন্মমাত্র রঙ্গের আরম্ভ হৈল তাঁর ।
তাজ্জব অদ্ভুত কথা বিস্ময় ব্যাপার ॥ ৯৭ ॥
ঢেকির লেজের তলে গর্ত এক থাকে ।
সদ্যোজাত ট্যাঁ করিয়া তথা গেছে ঢুকে ॥ ৯৮ ॥
ধনী কামারিনী ছিল অদূরে বসিয়ে ।
শিশুর রোদন শুনি উতরিল ধেয়ে ॥ ৯৯ ॥
মহানন্দে আসি ধনী ইতি উতি চায় ।
সৃতিকা-আগারে শিশু দেখিতে না পায় ॥ ১০০ ॥
বিস্ময় মানিয়া ধনী খুঁজে চারিধারে ।
পায় শেষে ঢেকিলেজ-গর্তের ভিতরে ॥ ১০১ ॥
সুদীর্ঘ আকার শিশু পরম সুন্দর ।
শোভা পার গায় বর্ণ জিনি শশধর ॥ ১০২ ॥
চাটুয্যে মশায়ে ধনী ডাকে উভরায় ।
পরম সুন্দর শিশু দেখনা হেথায় ॥ ১০৩ ॥
ত্বরা করি আসি দ্বিজ করে নিরীক্ষণ ।
দিব্য সুলক্ষণ অঙ্গে শিশু সুশোভন ॥ ১০৪ ॥
পুলকে পূর্ণিত দ্বিজ গদ গদ কায় ।
নয়ন নিস্পন্দ নাহি নিমিখ্ তাহায় ॥ ১০৫ ॥
সংগোপনে রাখিবারে কহিলেন কথা ।
যেন কেহ নাহি শুনে এ সব বারতা ॥ ১০৬ ॥
জনক জননী
ভাসে আনন্দ-সাগরে ।
বাড়য়ে আহলাদ যত পুত্রমুখ হেরে ॥ ১০৭ ॥
সূতিকা-আগারে যেন পূর্ণ
চন্দ্রোদয় ।
যেই দেখে তার মনে এই মত লয় ॥ ১০৮ ॥
শুনি প্রতিবাসী আসে দেখিবারে ছেলে ।
ছেলে দেখে সবে যায় নিজ ছেলে ভুলে ॥ ১০৯ ॥
একবার মাত্র শিশু হেরিয়া নয়নে ।
দিবানিশি
দেখে আসি এই হয় মনে ॥ ১১০ ॥
প্রতিবাসিনীরা সব আসি একে একে ।
অপূর্ব আনন্দ পায়
চাঁদমুখ দেখে ॥ ১১১ ॥
অপরূপ আনন্দেতে সবে ভাসমান। ।
কেন এ আহলাদ কিছু না বুঝে
সন্ধান ॥ ১১২ ॥
নানা কথা নানা জনে করে কানাকানি ।
এমন সুন্দর ছেলে না দেখি না
শুনি ॥ ১১৩ ॥
কেমন এ ছেলে দেখে জীবন জুড়ায় ।
শুধু অঙ্গ তবু যেন মণি-রত্ন গায় ॥ ১১৪ ॥
দেখেছি তো কত ছেলে এ ছেলে কেমন ।
দিবানিশি ব'সে দেখি এই হয় মন ॥ ১১৫ ॥
নিকটস্থ
গ্রামে গ্রামে পড়ে গেল সাড়া ।
হয়েছে বাছনি মুখ চন্দ্রিমার পাড়া ॥ ১১৬ ॥
দলে দলে
মেয়ে ছেলে আসে দেখিবারে ।
অপূর্ব আনন্দ পায় চাঁদমুখ হেরে ॥ ১১৭ ॥
এ সময়ে চাটুয্যের
আর্থিক সঙ্গতি ।
দিন দিন যায় যত ততই উন্নতি ॥ ১১৮ ॥
বিষয়-সম্বলে দ্বিজ অতিশয় কমি ।
ভূসম্পত্তি
মাত্র তাঁর সাতপোয়া জমি ॥ ১১৯ ॥
'লক্ষ্মীজলা' জমিনের এই হয় নাম ।
বর্ষায় ব্রাহ্মণ অগ্রে তিন গোছা ধান ॥ ১২০ ॥
স্বহস্তে ঈশান কোণে দিতেন পুঁতিয়া ।
জয় জয় রঘুবীর ঠাকুর বলিয়া ॥ ১২১ ॥
এই অল্প ভূমিখণ্ডে যাহা কিছু ফলে ।
বছরের গুজরান সেই ধানে চলে ॥ ১২২ ॥
আর এক ছিল তাঁর আয়ের উপায় ।
ধনাঢ্য ব্রাহ্মণ যারা জানিত তাঁহায় ॥ ১২৩ ॥
শুদ্ধসত্ত্ব সদাচারী ধর্মপথে মন ।
মাসে মাসে কিছু দিত ব্যয়ের কারণ ॥ ১২৪ ॥
যে কোন ব্রাহ্মণে দিলে গ্রহণ না হ'ত ।
বিশেষতঃ যে ব্রাহ্মণে শূদ্র যজাইত ॥ ১২৫ ॥
ব্যয়ের নাহিক ত্রুটি অবস্থা যেমন ।
যেন
হোক দিনে রেতে খায় দশজন ॥ ১২৬ ॥
ছটি ছটি খান অন্ন ঘরে রঘুবীর ।
নিত্য নিত্য সমাগত
অতিথি ফকির ॥ ১২৭ ॥
প্রশস্ত পথের পাশে ব্রাহ্মণের ঘর ।
যে পথে অতিথি নাগা চলে
নিরন্তর ॥ ১২৮ ॥
সে পথে পুরুষোত্তমে যাত্রিগণ চলে ।
উঠে ব্রাহ্মণের ঘরে ক্ষুধা
তৃষ্ণা পেলে ॥ ১২৯ ॥
বড়ই দয়ার্দ্রচিত্ত গরীব ব্রাহ্মণ ।
সামান্য মাটির ঘর খড়-আচ্ছাদন ॥ ১৩০ ॥
তাও অতি ছোট ছোট নহে পরিসর ।
সংখ্যায় অনেক নয় তিনখানি ঘর ॥ ১৩১ ॥
তার মধ্যে একখানি ঢেঁকিশালা তাঁর ।
এখন যেখানে আছে ধানের হামার ॥ ১৩২ ॥
ভিটার ছপ্পর তাঁর বাহ্য দরশন ।
দেখিলেই মনে হয় দীন-নিকেতন ॥ ১৩৩ ॥
তথাপিহ হেন ভাব ভবন উপরে ।
দেখামাত্র দর্শকের মন প্রাণ হরে ॥ ১৩৪ ॥
চারি ধারে বৃক্ষ লতা অতি মনোরম ।
যেন মহা তপঃপর ঋষির আশ্রম ॥ ১৩৫ ॥
শুদ্ধসত্ত্বভাবময় শান্তিকর স্থান ।
ক্ষুধাতৃষ্ণাবারি দয়া সদা বিদ্ধমান ॥ ১৩৬ ॥
তৃষা দূর করিবারে পথিকনিচয় ।
উপনীত হলে পরে ব্রাহ্মণ-আলয় ॥ ১৩৭ ॥
অতি আনন্দিত তেহ মহা সমাদরে ।
না খাইয়ে শাক-অন্ন নাহি দেন ছেড়ে ॥ ১৩৮ ॥
আর্থিক উন্নতি এই অন্যে অন্ন-দান ।
কোথা হতে জুটে ঘরে না জানে সন্ধান ॥ ১৩৯ ॥
প্রভু পুত্র যার তার অভাব কিসের ।
লক্ষ্মী ঘরে আড়ি ধরা ভাণ্ডারী কুবের ॥ ১৪০ ॥
পিতা মাতা প্রতিবাসী বুঝিতে না পারে ।
শিশুরূপী ভগবান কত খেলা করে ॥ ১৪১ ॥
একদিন
আই ঠাকুরানী লয়ে ছেলে ।
সূর্য-তাপ দেন গায় শোয়াইয়া কোলে ॥ ১৪২ ॥
বিশ্বম্ভর আবেশ
হইল শিশু-গায় ।
কোলে ছেলে বড় ভারী আই টের পায় ॥ ১৪৩ ॥
অসহ্য দেখিয়া থোন কুলার উপরে ।
সশয্যা সে কুলাখান চড় চড় করে ॥ ১৪৪ ॥
কি হোল কি হোল বলি করেন রোদন ।
নিশ্চল
সুস্থির শিশু বিহীন স্পন্দন ॥ ১৪৫ ॥
কুলা হ'তে পুনঃ কোলে লইবার তরে ।
বার বার
ঠাকুরানী কত চেষ্টা করে ॥ ১৪৬ ॥
কোনমতে উঠাইতে না পারে বাছনি ।
তখন ব্যাকুল প্রাণে
কাঁদেন জননী ॥ ১৪৭ ॥
শুনিয়া রোদন-ধ্বনি যে যথায় ছিল ।
সন্নিধানে ত্বরান্বিত আসিয়া
জুটিল ॥ ১৪৮ ॥
আই ঠাকুরানী কন ছেলে কেন ভারি ।
কুলা হ'তে কোলে আর উঠাতে না পারি ॥ ১৪৯ ॥
অদূরে নিম্বের এক বড় বৃক্ষ আছে ।
তায় বাসা ব্রহ্মদ্বৈত্য শিশুরে ধরেছে ॥ ১৫০ ॥
মনে
এই অনুমান করি লোকজন ।
ভুতুড়িয়া আনিবারে পাঠায় তখন ॥ ১৫১ ॥
কাঁদুনি গাহিয়া মন্ত্র ভুতুড়িয়া বলে ।
হালকা হইল শিশু উঠাইল কোলে ॥ ১৫২ ॥
আর দিন ছেলে রাখি গৃহ কাজে যান ।
শয্যা-সন্নিকটে এক আছিল উনান ॥ ১৫৩ ॥
আগুন না ছিল তার ছিল মাত্র পাঁশ ।
তখন ছেলের বয়ঃ দুই তিন মাস ॥ ১৫৪ ॥
বিছানা হইতে ছেলে গিয়াছেন সরে ।
অর্ধেক উনান মধ্যে অর্ধেক বাহিরে ॥ ১৫৫ ॥
সুকান্তি শিশুর গায় চাঁদ হারে দেখে ।
লুটালুটি যায় ভূ'য়ে ধুলা ছাই মেখে ॥ ১৫৬ ॥
ছুটাছুটি আসে আই দেখিয়া ব্যাপার ।
পরাণ-পুতুলি যথা লুটায় তাঁহার ॥ ১৫৭ ॥
অতি চীৎকার করে উঠাইয়া কোলে ।
বলেন কি হেতু দেখি দ্বীর্ঘকায় ছেলে ॥ ১৫৮ ॥
এই শোয়াইয়া গেছি বিছানা উপর ।
কে বল ফেলিল লয়ে উনান ভিতর ॥ ১৫৯ ॥
কেমনে হইল ছেলে দীর্ঘতায় কায় ।
এই ছোট দেখে রেখে গেছি বিছানায় ॥ ১৬০ ॥
এতেক কহিয়া যবে কাঁদেন জননী ।
শুনি ধেয়ে উতরিল ধানী কামারিনী ॥ ১৬১ ॥
গরজিয়া কামারিনী বলিল বচন ।
মা হইয়া অমঙ্গল কহ কি কারণ ॥ ১৬২ ॥
দাও দাও ছেলে মোরে গা ঝাড়িয়া দিব ।
যদি কিছু হ'য়ে থাকে মন্তরে মারিব ॥ ১৬৩ ॥
এত বলি লয়ে করে মন্ত্র উচ্চারণ ।
তখনি হইল ছেলে পূর্বের মতন ॥ ১৬৪ ॥
কেবা ধনী কামারিনী নন্দরানী প্রায় ।
অদ্ভুত রমণী দেখি প্রভুর লীলায় ॥ ১৬৫ ॥
শিশুরূপী ভগবান চাটুয্যে-ভবনে ।
আরম্ভ করিলা বেলা যেন আসে মনে ॥ ১৬৬ ॥
বিচিত্র প্রভুর খেলা অবোধ্য আভাস ।
পিতামাতা প্রতিবাসী সবার তরাস ॥ ১৬৭ ॥
দিনে দিনে তিন চারি মাস হৈল গত ।
ঘটনা ঘটিল এক অতি অদ্ভুত ॥ ১৬৮ ॥
সংসারের কার্যে আই যান গৃহান্তরে ।
পঞ্চম মাসের শিশু শোয়াইয়া ঘরে ॥ ১৬৯ ॥
ফিরে আসি দেখে আই নিজ ছেলে নাই ।
মশারিপ্রমাণ আর জন তাঁর ঠাঁই ॥ ১৭০ ॥
উচ্চৈঃস্বারে ডাকে আই পতিরে সম্ভাষি ।
বিছানায় ছেলে নাই, দেখ না গো আসি ॥ ১৭১ ॥
এ কেবা রয়েছে শুয়ে অতি দীর্ঘকায় ।
দেখ কে লইল বল আমার বাছায় ॥ ১৭২ ॥
ব্রাহ্মণ ভয়ার্ত হয়ে যান তরান্বিতে ।
প্রবেশিলা সেই ঘরে ভার্যার সহিতে ॥ ১৭৩ ॥
দেখেন শুইয়া খেলে আপন বাছনি ।
তুলে কোলে দেন মাই আই ঠাকুরানী ॥ ১৭৪ ॥
বিস্ময়া
ভার্যায় দেখি দ্বিজবর ক'ন ।
যা দেখেছ সত্য, আছে তাহার কারণ ॥ ১৭৫ ॥
কদাচ এ সব কথা
না কবে কাহারে ।
অসম্ভব এ সব সম্ভব নহে নরে ॥ ১৭৬ ॥
শাবাশ মায়ার খেলা যাই বলিহারি ।
হৃদয়ে উদয় যাহা বর্ণিতে না পারি ॥ ১৭৭ ॥
ঐশ্বর্য ভুলিয়া গেল ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী ।
সস্নেহে দেখেন বারবার মুখখানি ॥ ১৭৮ ॥
ঘন ঘন দেন চুম্ব বদন-কমলে ।
নয়নের ধারা ব'য়ে
পড়ে বক্ষঃস্থলে ॥ ১৭৯ ॥
শুভদিনে ষষ্ঠ মাসে মুখে ভাত পড়ে ।
আনন্দের নাহি সীমা ব্রাহ্মণের ঘরে ॥ ১৮০ ॥
গরীব
ব্রাহ্মণবাড়ি কিন্তু আজি দিনে ।
চর্ব-চুষ্য-লেহ-পেয় পায় চারি বর্ণে ॥ ১৮১ ॥
গ্রামের ব্রাহ্মণ আর যতেক সজ্জাতি ।
বৈষ্ণব ভিখারী প্রতিবাসী জোলা তাঁতী ॥ ১৮২ ॥
সমভাবে সকলে উদর পুরি খায় ।
কুলের ঠাকুর রঘুবীরের কৃপায় ॥ ১৮৩ ॥
আজি আনন্দের স্রোত
তথা যাহা বহে ।
তিল-আধ সাধ্য কাহার বিবরিয়া কহে ॥ ১৮৪॥
এদিকে দেবান্নে তৃপ্তি হইল
উদর ।
অন্যদিকে মনের প্রাণের তৃপ্তিকর ॥ ১৮৫ ॥
পরম সুন্দর শিশু রূপের আধার ।
শোভে
অঙ্গরূপে জিনি মণি অলঙ্কার ॥ ১৮৬ ॥
নব বস্ত্র আভরণ সুশোভিত গায় ।
ভালে চন্দনের
রেখা হারায় শোভায় ॥ ১৮৭ ॥
কিবা শোভা পায় গায় চন্দনাভরণে ।
দীপ্তিহীন মণিরাজি তার
সন্নিধানে ॥ ১৮৮ ॥
একে তো সুন্দর তায় চন্দনে চর্চিত ।
যে দেখে স্বচক্ষে হয় সেই
মুগ্ধচিত ॥ ১৮৯ ॥
বিরিঞ্চিবাঞ্ছিত দৃশ্য বদনমণ্ডলে ।
কামারপুকুরবাসী দেখে ল'য়ে
কোলে ॥ ১৯০ ॥
নাম রাখিবার কাল এল দিনে দিনে ।
কি নাম রাখিবে পিতামাতা ভাবে মনে ॥ ১৯১ ॥
গয়াধামে গদাধর করি দরশন ।
পাইলেন কোলে হেন কুমার রতন ॥ ১৯২ ॥
সেই হেতু রাখিলেন নাম
গদাধর ।
ডাকেন গদাই বলি করিয়া আদর ॥ ১৯৩ ॥
গুরুদত্ত নাম রামকৃষ্ণ নাম খ্যাত ।
রামকৃষ্ণ পরমহংস ভুবনে বিদিত ॥ ১৯৪ ॥
জোড়া নামে গড়া নাম নামের মহিমা ।
বেদবিধি নাহি পারে করিবারে সীমা ॥ ১৯৫ ॥
জীবের
পরম ধন পরিণামে গতি ।
ভাগ্যবান নামে যার জনমে পিরীতি ॥ ১৯৬ ॥
রতি-মতি রামকৃষ্ণ
নামে এই চাই ।
কৃপা করি দেহ দীনে ঠাকুর গদাই ॥ ১৯৭ ॥
আর এক রূপা ভিক্ষা ওহে
লীলাপতি ।
ঊরহ হৃদয়ে কণ্ঠে লিখাইতে পুঁথি ॥ ১৯৮ ॥
১
পূর্ব সংস্করণে (১ম সংস্করণ) ১২৪১
সন ১০ই
ফাল্গুন লেখা হইয়াছিল; অভ্রান্ত 'লীলাপ্রসঙ্গে'র
মতে উহার পরিবর্তন করা হইল। — লেখক
ঐ গ্রন্থমতে জন্ম রাত্রি অর্থদণ্ড
অবশিষ্ট থাকিতে । — প্রঃ