প্রথম খণ্ড
চিনুশাঁখারীর মিষ্টান্ন ও মালা গ্রহণ
জয়
জয় রামকৃষ্ণ বাঞ্ছাকল্পতরু ।
জয় জয় ভগবান জগতের গুরু ॥
জয় জয় রামকৃষ্ণ ইষ্টগোষ্ঠীগণ ।
সবার চরণরেণু মাগে এ অধম ॥
অতীত বেদান্ত বেদ গীতাদি পুরাণ ।
তপ-জপ যাগ-যজ্ঞ কোটি অনুষ্ঠান ॥ ১ ॥
দরশনে চারিধামে যে ফল না ফলে ।
এক রামকৃষ্ণ-কথা গাইলে শুনিলে ॥ ২ ॥
অনায়াসে ফলে তায় লক্ষাধিক ফল ।
রামকৃষ্ণ-কথা হেন শ্রবণ-মঙ্গল ॥ ৩ ॥
ছার আমি মুঢ় কিবা প্রভু-কথা জানি ।
বিরচিত বিশ্ব যাঁর, অখিলের স্বামী ॥ ৪ ॥
ভেসে গেছে শুকদেব, মহাবেদব্যাস ।
আভাস-প্রকাশে লাগে অন্তরে তরাস ॥ ৫ ॥
কিবা রামকৃষ্ণ প্রভু কি তাঁর মহিমা ।
ক্ষুদ্র চিতে করিতে না পারি কোন সীমা ॥ ৬ ॥
সামান্য হৃদয় নহে অণুর আধার ।
প্রভু-লীলা সিন্ধুবৎ অকূল পাথার ॥ ৭ ॥
বিশাল তরঙ্গ তায় বিশ্ব-চূড়া ডুবে ।
ভাসে কত বিষ্ণু, বিধি, খাবি খায় শিবে ॥ ৮ ॥
অগণ্য ব্রহ্মাণ্ড নীচে বালুকার বন ।
সহস্র সহস্র তায় প্রকাণ্ড তপন ॥ ৯ ॥
দীপ্তিহীন ক্ষীণপ্রভা খাদ্যোতের প্রায় ।
বিলুপ্ত তরঙ্গে কভু কভু বাহিরায় ॥ ১০ ॥
জগৎ-গরাসী নাম মহান্ প্রলয় ।
সেই দেখে চমকে হৃদয়ে পায় ভয় ॥ ১১ ॥
অচিন্ত্য অসীম যদি এদিকে আবার ।
কৃপাময় রামকৃষ্ণ কৃপায় তাঁহার ॥ ১২ ॥
ইন্দ্রিয় অতীত যাহা বোধগম্য নয় ।
চোখে চোখে পলকে পলকে দৃষ্ট হয় ॥ ১৩ ॥
ঘুচে সন্দ, মন দ্বন্দ্ব করে পরিহার ।
আলোক উগারি নাশে নিবিড় আঁধার ॥ ১৪ ॥
বিষম
মায়ার বন্ধ সব টুটে যায় ।
তাই শ্রীপ্রভুর কথা না ফুটে কথায় ॥ ১৫ ॥
চিহ্ন নামে
একজন শাঁখারীর জাতি ।
দরিদ্র তাহাতে বৃদ্ধ, গ্রামেতে বসতি ॥ ১৬ ॥
ব্যবসায় অল্প আয়
কষ্টে গুজরান ।
কিন্তু তার গদাধরে ছিল বড় টান ॥ ১৭ ॥
গদাধর তার ঘরে যান নিতি
নিতি ।
সবে সুবিদিত দুঁহে বড়ই পিরীতি ॥ ১৮ ॥
গদাধরে সমাদরে বসার আসনে ।
মিষ্টান্ন
যা মিলে ভাল তাই দেয় এনে ॥ ১৯ ॥
ধীরে ধীরে খান প্রভু, চিনু বসি দেখে ।
দোকানে
খদ্দের এলে খাতির না রাখে ॥ ২০ ॥
প্রেমে গদগদ চিত চিনু ভক্তিমান ।
বিহ্বল এমন যেন
শূন্য বাহ্যজ্ঞান ॥ ২১ ॥
কিবা বলে কিবা করে কোন বোধ নাই ।
না পাল্টি আঁখি দুটি দেখেন গদাাই ॥ ২২ ॥
একদিন চিনুর কি ভাব হৈল চিতে ।
চয়ন করিয়া ফুল দিব্য মালা গাঁথে ॥ ২৩ ॥
অনুরাগে
গাঁথা মালা পরিপাটি কত ।
হেনকালে গদাধর তথা উপনীত ॥ ২৪ ॥
হেরে তাঁরে চিনুর আনন্দ নাহি ধরে ।
মালা গাঁথা সাঙ্গ করি চলিল বাজারে ॥ ২৫ ॥
আনিল মিষ্টান্ন কিনি মনের মতন ।
স-মালা মিষ্টান্ন ক'রে কাপড়ে গোপন ॥ ২৬ ॥
ল'য়ে সঙ্গে গদাধর চিনু মাঠে চলে ।
অন্তর প্রান্তরে জনশূন্য বৃক্ষতলে ॥ ২৭ ॥
কেহ কোথা নাই চিনু চেয়ে চারিপানে ।
জানুপাতি করজোড়ে বৈসে চামুখানে ॥ ২৮ ॥
যতনের গাঁথা মালা বাহির করিয়ে ।
প্রভুর গলায় দেয় গদগদ হয়ে ॥ ২৯ ॥
মিষ্টান্ন খাওয়ান হাতে ধরি গদাধরে ।
শূন্য-বাক্ মুখ, আঁখি ঝরঝর ঝরে ॥ ৩০ ॥
দিনকর-কর লুপ্ত মেঘ অন্তরালে ।
লুকাইল আঁখি-দৃষ্টি নয়নের জলে ॥ ৩১ ॥
মিষ্টান্ন সহিত হাত পড়ে নানা স্থানে ।
কভু নাকে, কভু চক্ষে, কভু পড়ে কানে ॥ ৩২ ॥
আপনে চিনুর হাত করিয়া ধারণ ।
আনন্দে করিলা তার মিষ্টান্ন ভোজন ॥ ৩৩ ॥
ভোজন-সমাপ্তে চিনু আপনা-সম্বরি ।
প্রভুরে কহেন কত করজোড় করি ॥ ৩৪ ॥
আগত হয়েছে কাল জরাযুক্ত তনু ।
কত হবে লীলা-খেলা দেখিতে না পেনু ॥ ৩৫ ॥
বড়ই রহিল দুঃখ আমার অন্তরে ।
করুণ কটাক্ষে রেখ অধীন কিঙ্করে ॥ ৩৬ ॥
ধন্য ধন্য চিনু দুটি দেহ পদরেণু ।
যথার্থ তোমার নাম হইয়াছে চিনু ॥ ৩৭ ॥
চেনা কাজ বুঝ ভাল তাই চিনু নাম ।
তোমার চরণে করি অগণ্য প্রণাম ॥ ৩৮ ॥
বৃদ্ধ বটে চিনিবাস আঁটা-সোটা কায় ।
গায়েতে প্রচুর বল রোগ-নাই তায় ॥ ৩৯ ॥
প্রভুরে দেখিয়া চিহ্ন এত মত্ত হ'ত ।
কাঁধেতে চড়ায়ে তাঁয় প্রচুর নাচিত ॥ ৪০ ॥
বলরাম-অবতার ভক্ত চিনিবাস ।
দাদা শব্দে শ্রীপ্রভুর আছিল সম্ভাষ ॥ ৪১ ॥
দাদা ব'লে ডাকিলে গলিয়ে যেত চিমু ।
পরম উল্লাস মন গদগদ তনু ॥ ৪২ ॥
অচল ভকতি হৃদে সৎশাস্ত্রবিৎ ।
ভাগবতে চিনিবাস অতি
সুপণ্ডিত ॥ ৪৩ ॥
প্রভুর সহিত হয় নানা তর্কবাদ ।
কখন চটিত তর্কে, কখন আহলাদ ॥ ৪৪ ॥
শাস্ত্র লয়ে তর্কদ্বন্দ্ব কভু এত দূর ।
সপ্তম ছাড়িয়া রাগ উঠিত চিনুর ॥ ৪৫ ॥
উভয়ে
উভয়ে কথা কত মুখে মুখে ।
তুমূল বিবাদ দ্বন্দ্ব হয় মহা রোখে ॥ ৪৬ ॥
পুনশ্চ সাক্ষাৎ
নহে শপথ করিয়া ।
পলাইত নিজ ঘরে দুরু দুরু হিয়া ॥ ৪৭ ॥
প্রভুর উত্তর কথা চিনুর
মতন ।
আমার সঙ্কল্প নহে পুনঃ দরশন ॥ ৪৮ ॥
হেন বিবাদের মাত্র দণ্ডেকের পর ।
উভয়েই
মহাখুশী পুনঃ একত্তর ॥ ৪৯ ॥
প্রায় হয় এই খেলা চিনিবাস-সাথ ।
পিতামহ পৌত্রে যদি
বয়সে তফাত ॥ ৫০ ॥
চরিত্রে চিনুর বহে বিছরের ধারা ।
ভক্তিতে বিভোর চিত্ত উন্মাদের
পারা ॥ ৫১ ॥
বিষয়সম্পত্তিহীন খেটে যেতে হয় ।
পোষ্যবর্গ আছে ঘরে একাকী সে নয় ॥ ৫২ ॥
সে
ভাবনা কখন না উদয় অন্তরে ।
মিষ্টান্ন খাওয়ান কিন্তু নিত্য গদাধরে ॥ ৫৩ ॥
সুন্দর
তাঁহার ভাব গদাইর সনে ।
দিবানিশি তাঁর চিন্তা বর্তমান মনে ॥ ৫৪ ॥
চিনিবাস
প্রভুদেবে বুঝেছিল ঠিক ।
যথার্থ বাসিত তাঁহে প্রাণের অধিক ॥ ৫৫ ॥
কেবা সম তাঁর যেবা 'বাসে গদাধরে ।
অধম পামর তাঁর রূপা ভিক্ষা করে ॥ ৫৬ ॥
শ্রীপ্রভুর বাল্যলীলা অমৃত ভারতী ।
এক মনে গাও রামকৃষ্ণ-লীলা-গীতি ॥ ৫৭ ॥